দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগের জন্য পুঁজিবাজার নির্ভর হতেই হবে – ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

সময়: রবিবার, জানুয়ারি ২৬, ২০২০ ১২:৫৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ


‘দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগের জন্য আমাদের পুঁজিবাজার নির্ভর হতেই হবে। সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যখন আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা তাদের দীর্ঘ মেয়াদি অর্থায়নের জন্য পুঁজিবাজারকেই বেছে নেবে।’ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সর্বশেষ তত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা
ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন-এর ডেপুটি এডিটর এম এ খালেকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন। তার সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ এখানে উপস্থাপন করা হলোÑ

দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন: ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর ‘কস্ট অব ফান্ড’ বেশি এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণও অস্বাভাবিক রকম বেশি। এই অবস্থায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোর এই উদ্যোগ কতটা টেকসই হবে বলে মনে করেন?

ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: আমি এটার ব্যাপারে খুবই সন্দিহান। আমাদের দেশে ঋণের উপর আরোপিত সুদের হার এবং আমানতের সুদের হারের মধ্যে যে ব্যবধান, যাকে ‘স্প্রেড’ বলা হয়Ñ তা কখনোই সাড়ে ৪ শতাংশের নিচে আসেনি। যদি চেষ্টা করে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়Ñ তাহলে আমানতের উপর প্রদেয় সুদের হার হবে ৫ শতাংশ। এখন মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ৬ শতাংশের কাছাকাছি। গত ডিসেম্বর মাসে বিগত ১২ মাসের গড় হিসাবে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। আর পয়েন্ট টু পয়েন্ট অর্থাৎ আগের বছরের ডিসেম্বর মাসের সঙ্গে তুলনা করলে এটা ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তার অর্থ হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির হার ব্যাংক কর্তৃক আমানতের উপর প্রদেয় সুদের হারের চেয়ে বেশি। এই অবস্থায় মানুষ ব্যাংকে আমানত কেনো রাখবে? সাম্প্রতিক সময়ে আমরা লক্ষ্য করছি বেশ কিছু দিন ধরে ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে তো তাদের এ্যাডভান্স-ডিপোজিট রেশিও মেইনটেন করতে হবে। ব্যাংক যদি তুলনামূলক স্বল্প সুদে আমানত সংগ্রহ করতে না পারে, তাহলে তারা স্বল্প সুদে ঋণ দিতে পারবে না। এই অবস্থায় ব্যাংকগুলোর ঋণদানের সক্ষমতা অনেকটাই হ্রাস পাবে।

দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন: ব্যাংকগুলোকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দান করতে বাধ্য করা হলে তারা কি ঋণ সংকোচন নীতি গ্রহণ করতে পারে বলে মনে করেন?

ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: আপনি সুদের হার নির্ধারণ করে দিলেন। কিন্তু ঋণের কোয়ান্টিটি তো নির্ধারণ করে দিচ্ছেন না, এটা দিতে পারবেনও না। ব্যাংকগুলো কত পরিমাণ ঋণ দেবেÑ তা নির্ভর করে ‘এ্যাডভান্স-ডিপোজিট রেশিও’র উপর। আপনি যদি ‘এ্যাডভান্স-ডিপোজিট রেশিও’ আরো সহজীকরণ করেনÑ তাহলে আন্তর্জাতিক রেটিং এর উপর তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। সেই অবস্থায় আপনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা হারাতে পারেন। ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনায় অসুবিধা হতে পারে। কাজেই ব্যাংক ঋণ ও আমানতের সুদের হার এভাবে নির্ধারণ করে দেয়াটা আমি খুব একটা বাস্তবসম্মত বলে মনে করি না।

দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন: শেয়ারবাজারের অবস্থা কিছু দিন ধরেই বেশ খারাপ যাচ্ছিল। কিন্তু স্টেকহোন্ডারদের একাংশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর বাজারে চাঙ্গাভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর কারণ কি?

ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: এর কারণ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এমন কিছু সিদ্ধান্ত এসেছে, যা শেয়ারবাজার উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বিনিয়োগকারিদের মাঝে এক ধরনের আস্থা ফিরে এসেছে। তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। যেসব সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছেÑ তা কতটা বাস্তবায়িত হবে তার উপর বাজারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। সভায় বিনিয়োগকারীদের সংগঠনের পক্ষ থেকে লো কস্টে ১০ হাজার কোটি টাকার ফান্ড দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যাতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো এখান থেকে অর্থ নিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। স্টক মার্কেটে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ আরো বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে বিনিয়োগকারীরা আশান্বিত হয়েছেন। তারা নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তাদের মাঝে বাজার নিয়ে কিছুটা হলেও আস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে এসব প্রস্তাবনার কতটা বাস্তবায়িত হয় এবং বাজার কতটা টেকসই হয়। আমি আবারো বলছি, ব্যাংকিং সেক্টরে যে সমস্যা বিরাজ করছেÑ তা দূরীকরণ করা না গেলে শেয়ারবাজারের এই আস্থা টেকসই করা মুশকিল হবে। ব্যাংকিং খাত স্টক মার্কেটকে দু’ভাবে প্রভাবিত করে। প্রথমত, ব্যাংকিং খাত আমাদের মূলধনী বাজারের একটি বড় অংশ ধারণ করে আছে। কাজেই ব্যাংকিং সেক্টরের শেয়ারের দাম কমে গেলে তার প্রভাব অন্য খাতের শেয়ারের উপরও পড়ে। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগকারীদের অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে থাকে। এই অবস্থায় ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি যদি কমে যায়Ñ তাহলে তার প্রভাব স্টক মার্কেটেও পড়বে। আরো একটি বড় ব্যাপার হচ্ছে গ্রামীণফোনের সমস্যা। এটাও তো নিরসন হচ্ছে না। নতুন এবং ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারবাজারে আসছে না। ওয়ালটনের শেয়ারবাজারে আসার কথা ছিল। আমি জানি না এটা কোন্ পর্যায়ে আছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানির শেয়ার নিয়ে আসার কথা তো প্রায় এক দশক ধরেই শুনছি। কিন্তু এগুলো এখনো বাজারে আসছে না। কয়েক বছর আগে ২৬টি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে শেয়ারবাজারে নিয়ে আসার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো অজ্ঞাত কারণে বাজারে আসেনি। এসব সমস্যা সমাধান করা না গেলে বাজারের অবস্থা কতটা টেকসই হবেÑ তা বলা মুশকিল।

দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন: কিছু দিন ধরে একটি গুজব শোনা যাচ্ছে যে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। এর সত্যতা কতটা বলে মনে করেন?

ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেকেই তাদের বিনিয়োগ ইতোমধ্যেই প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এখন তো শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগের হার হচ্ছে নেতিবাচক। অর্থাৎ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যে পরিমাণ নতুন শেয়ার কিনছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাও শেয়ারবাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। এ জন্যই আমি বলেছি, বাংলাদেশের স্টক মার্কেটে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিয়ে বেশি মাথা ঘামানো ঠিক নয়। তারা অনেক সময়ই একটি সমস্যাকে ঘনীভুত করে ফেলে। ম্যাক্রো ইকোনমিক-এর কিছু ইন্ডিকেট আছে, যে কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের শেয়ারবাজারের প্রতি তেমন একটা বেশি আকৃষ্ট হবে না। সার্বিক অর্থনৈতিক ইন্ডেকেটরগুলো যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে, একমাত্র রেমিটেন্স আয় ব্যতীত অন্য প্রায় সব ইন্ডিকেটর নেতিবাচক ধারায় প্রবাহমান রয়েছে। রপ্তানি আয় নেতিবাচক, শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারী আমদানি নেতিবাচক, ব্যাংক ঋণ প্রবাহের অবস্থা ভালো নেই। স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের দাবি উত্থাপিত হচ্ছে। স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা হলে তার আগেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার থেকে বেরিয়ে যাবে। স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে মার্কিন ডলারের অঙ্কে তাদের তো লোকসান হবে। কাজেই আমি মনে করি, স্টক মার্কেটে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে খুব একটা মাতামাতির প্রয়োজন নেই।

দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন: আপনি তো বিএসইসি’র চেয়ারম্যান ছিলেন। আপনার দৃষ্টিতে স্টক মার্কেটের সমস্যা কি? বিদেশি কোম্পানিগুলো স্টক মার্কেটে না আসার কারণ কি?

ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: আমি মনে করি, এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ কাজ করছে। বিদেশি কোম্পানিগুলোর কথা যদি বলি তাহলে দেখবেন তারা কোনো ধরনের জবাবদিহিতার মধ্যে আসতে চায় না। যদিও তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কর মওকুফ সুবিধা প্রদান করা হয়। আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারবাজারে আসার ক্ষেত্রে আইনি কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কাজেই শেয়ারবাজারে বিদেশি কোম্পানিগুলোর শেয়ার আনতে গেলে এ্যাক্টিভলি নেগোসিয়েট করতে হবে। আমি যেমন এ্যাক্টিভলি নেগোসিয়েট করে বার্জার পেইন্টসকে শেয়ারবাজারে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। কাজেই সম্ভাবনাময় কোম্পানিগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে বাজারে নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে তাদের ভালো পরিমাণ প্রিমিয়াম দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর শেয়ার তো বাজারে আসছে না। বিদেশি কোম্পানির উদ্যোক্তারা মনে করেন সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানির শেয়ারবাজারে আনছে নাÑ তাহলে আমরা কেনো শেয়ারবাজারে যাবো?

দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন: শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা নি:সন্দেহে উদ্বেগজনক। বাজারের এই অবস্থার জন্য মূলত দায়ী ব্যাংকিং সেক্টরের দুরবস্থা। ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো তারল্য সঙ্কটে আছে। ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি নিয়েও মানুষের মনে সংশয় রয়েছে। ব্যাংকের শেয়ারেও দর পতন ঘটছে। শেয়ারবাজারের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ব্যাংকিং সেক্টর। কাজেই ব্যাংকিং সেক্টরের দুরবস্থা শেয়ারবাজারের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর ২০১৯ মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। অবলোপনকৃত ঋণ, পুন:তফসিলিকৃত ঋণ, মামলাধীন প্রকল্পের নিকট পাওনা ঋণ এই হিসাবের বাইরে রয়েছে। এগুলো যোগ করা হলে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এদিকে এককালীন ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ব্যাংক ঋণ ১০ বছরের জন্য পুন:তফসিলিকরণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা ব্যাংকিং সেক্টরে নৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে। পুন:তফসিলিকরণকৃত ঋণের সুদ হার হবে ৯ শতাংশ। অথচ যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে আসছেন তাদের সুদের হার ১২ থেকে ১৩ শতাংশ। এতে নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধকারীরা খেলাপি হতে উৎসাহিত হতে পারেন। এ ছাড়া ব্যাংকিং সেক্টরে সার্বিকভাবে সুশাসনের অভাব তো রয়েছেই। এসব কারণে ব্যাংকিং সেক্টর সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। বিনিয়োগকারীদের অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু তারল্য সঙ্কটের কারণে ব্যাংকগুলো চাহিদা ঋণ দিতে পারছে না। জুলাই-নভেম্বর সময়ে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ। এর প্রভাব শেয়ার মার্কেটে পড়ছে। শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থার জন্য বিনিয়োগকারীদেরও কিছুটা দায় রয়েছে। তারা অকারণে আশঙ্কায় ভোগেন। আমাদের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীদের হুজগে মেতে উঠার প্রবণতা খুব বেশি। অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ার আছে। বিনিয়োগকারীরা এসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারেন। শেয়ারমার্কেটে সব সময়ই এক ধরনের অনিশ্চয়তা থাকে। সেটা মেনে নিয়েই আমাদের বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা তা না করে অকারণ আতঙ্কে ভোগেন।

দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন: শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থার জন্য বিনিয়োগকারীদের আচরণ কতটা দায়ি বলে মনে করেন?

ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীদের আচরণেও কিছু সমস্যা রয়েছে। তাদের বিনিয়োগ কৌশলেই ভুল রয়েছে। সঞ্চয় বা বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের পুরোটাই যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে হয় নাÑ এটা বোধ হয় তারা জানেন না। বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে হবে। এছাড়া অনেকেই আছেন যারা আজ শেয়ার কিনে কালই তা বিক্রি করে দিতে চান। শেয়ার কেনার পর তা ধরে রাখতে হবে। শেয়ার ধরে রাখলে এক সময় ক্যাপিটাল গেইন হবে অথবা ডিভিডেন্ড পাওয়া যাবে। আমার একটি গবেষণায় উঠে এসেছে লম্বা সময় ধরে রাখলে যে কোনো বিনিয়োগের চেয়ে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগই বেশি মুনাফা দেয়।

দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন: উন্নত দেশগুলোতে দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগের জন্য সাধারণত পুঁজিবাজার থেকেই অর্থ আহরণ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এর বিপরীত চিত্রই প্রত্যক্ষ করা যায়। এর কারণ কি?

ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগের জন্য আমাদের পুঁজিবাজার নির্ভর হতেই হবে। সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয় যখন আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা তাদের দীর্ঘ মেয়াদি অর্থায়নের জন্য পুঁজিবাজারকেই বেছে নেবে। উদ্যোক্তাদের দিক থেকে শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি তোলা হচ্ছে ঝুঁকিমুক্ত থাকা। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে শিল্প-কারখানা স্থাপন করা হলে কোম্পানির লাভ হলেও ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করতে হয় আবার লোকসান হলেও ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু পুঁজিবাজার থেকে অর্থায়ন সংগ্রহ করা হলে লোকসান হলে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে হয় না। এতে অর্থ সংগ্রহকারীর উপর চাপ হ্রাস পায়। পুঁজিবাজারকে উজ্জীবিত করা এবং ব্যাংকের উপর চাপ কমানোর জন্য সরকার কোম্পানিগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন। সরকার এধরনের একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আমি এ ধরনের একটি উদ্যোগ দেখতে পাবো আশাবাদি। উন্নত বিশে^র কথা বাদ দিলেও দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শেয়ার বাজার এখনো সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের কার্যকর উদ্যোগ নিতেই হবে।

দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন: বাজারের সব পক্ষকে নিয়ে অর্থমন্ত্রী মিটিং করেছেন। আগামীতে আরো মিটিং হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ধরনের মিটিং বাজার উন্নয়নে কতটা অবদান রাখবে বলে মনে করেন?

ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: শুধু বৈঠক করে কোনো লাভ হবে বলে আমি মনে করি না। সবার আগে প্রয়োজন ব্যাংকিং সেক্টরের উন্নতি সাধন করা। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ৪/৫ বছর আগে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ২৬টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে তা শেয়ারবাজারে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমি তখন তাঁকে বলেছিলাম, শুধু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করলেই হবে না অনবরত চাপ দিয়ে এদের বাজারে নিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় এর বাজারে আসবে না। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ২৬টি প্রতিষ্ঠানের একটিও বাজারে আনা যায়নি। বহুজাতিক বা স্থানীয় কোনো ভালো কোম্পানিও শেয়ার বাজারে আসেনি। ছোট ছোট কিছু কোম্পানি বাজারে এসেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বাজারে না আসার কারণ হচ্ছে তারা জবাবদিহিতার বাইরে থাকতে চায়।
#

Share
নিউজটি ১০৯৪ বার পড়া হয়েছে ।
Tagged