নানা অনিয়মে ডুবতে বসেছে আরো তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান

সময়: রবিবার, জুলাই ২১, ২০১৯ ৪:৪৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ


সালাহউদ্দিন মাহমুদ : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের রেশ কাটতে না কাটতেই আর্থিক খাতের আরও তিনটি কোম্পানির আর্থিক অবস্থার বিষয়ে রেড এ্যালার্ট তথা সতর্ক বার্তা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর নিরীক্ষকরা। কোম্পানি তিনটি হচ্ছে- ‘ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস’, ‘বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স করপোরেশন’ ও ‘ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড’। খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতিসহ নানা অনিয়মের কারণে ডুবতে বসেছে এ কোম্পানি তিনটি। নিরীক্ষকদের মতে, কোম্পানি তিনটির আর্থিক খাতের অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে রয়েছে।
ফলে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন বিনিয়োগকারীরা। এদিকে নিরীক্ষকদের মতামতের জের ধরে গত সাত থেকে আট কার্যদিবস টানা দরপতনে রয়েছে কোম্পানিগুলোর শেয়ার।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, আর্থিকখাতে এ ধরনের কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরে সমস্যায় রয়েছে। খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ঘাটতি, অনিয়ম ও গ্রাহক আমানত ফেরত দিতে না পারার কারণে ইতোমধ্যে বিনিয়োগকারীর আস্থা হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং হুমকির মুখে : তালিকাভুক্ত কোম্পানি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস হুমকির মুখে পড়েছে। কোম্পানিটির পাহাড়সম খেলাপি ঋণের বিপরীতে সামান্য প্রভিশন সঞ্চিতি রয়েছে। কোম্পানির নিরীক্ষকের দেয়া প্রতিবেদনে এই উদ্বেগের বিষয় উঠে এসেছে। নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ সমাপ্ত হিসাব বছরের নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে কোম্পানিটির মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৫৮ কোটি ৪৩ লাখ ৭০ হাজার ৬৬৫ টাকা। এর বিপরীতে কোম্পানিটি প্রভিশন সংরক্ষণ করেছে ৫ কোটি ৯৫ লাখ ৮৪ হাজার ৮৫৩ টাকা। সে হিসাবে কোম্পানিটির খোলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি ঘাটতি ২৫২ কোটি ৪৭ লাখ ৮৫ হাজার ৮১২ টাকা। এর ভিত্তিতে নিরীক্ষক বলছে কোম্পানির অবস্থা হুমকির মুখে।
নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ সমাপ্ত হিসাব বছরের নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে কোম্পানির অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো নেতিবাচক রয়েছে। স্বল্পমেয়াদি তারল্য সংকটের কারণে কোম্পানিটি তার কিছু আমানতকারী ও ঋণদাতাদের কাছে অর্থ প্রদানে সমস্যা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ অর্থায়নের জন্য কোম্পানিটির স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভরতা ছিল। ফলে কোম্পানির খেলাপি বিনিয়োগকৃত সম্পদ (ঋণ, লিজ এবং অগ্রিম) ২.১১ শতাংশ হারে বেড়েছে।
এদিকে কোম্পানিটির ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) দেখানো হয়েছে ৬৩ লাখ ৪৯ হাজার ৪৫৩ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী মোট টার্ম ডিপোজিটের আড়াই শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে সিআরআর হিসাবে রাখতে হবে। সেই হিসাবে কোম্পানির মোট টার্ম ডিপোজিট ১ হাজার ২৫৭ কোটি ৮৩ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯ টাকা। আর গড় টার্ম ডিপোজিট ৩১ কোটি ৪৪ লাখ ৫৯ হাজার ১৫২ টাকা। তবে কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট হিসাব করেছে ৬৩ লাখ ৪৯ হাজার ৪৫৩ টাকা, যা সিআরআর এর দাবির তুলানায় ৯৮ শতাংশ কম।
আর সংশোধিত ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন রেগুলেশন-১৯৯৪ এর সেকশন (ঘ) অনুযায়ী, কোম্পানিটির ক্যাপিটাল অ্যাডিক্যুইসি রেশিওতে (সিএআর) ন্যূনতম রেগুলেটরি ক্যাপিটাল (কোর ক্যাপিটাল অ্যান্ড সাপ্লিমেন্টরি ক্যাপিটাল) হবে ৪০৪ কোটি ৯৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৪ টাকা। সেখানে কোম্পানির রয়েছে ৩২০ কোটি ২৮ লাখ ৯৩ হাজার ৪৯০ টাকা। এখানে রেগুলেটরি ক্যাপিটাল ঘাটতি রয়েছে ৮৪ কোটি ৬৫ লাখ ৭১ হাজার ৭৪ টাকা, যা ন্যূনতম দাবির ২১ শতাংশ কম।
মোট এক্সপোজার অনুযায়ী কোম্পানিটি ৩০ শতাংশ অতিক্রম করেনি। তবে কোম্পানিটি তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ঋণ সুবিধা বাড়িয়েছে। সহযোগী প্রতিষ্ঠানে কোম্পানির ঋণ ২২৮ কোটি ৩৯ লাখ ৯৯ হাজার ৬৫৯ টাকা, যা মোট ঋণের ৮৩ শতাংশ অতিক্রম করেছে। এতে কোম্পানিটি সংশোধিত ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন রেগুলেশন-১৯৯৩ লঙ্ঘন করেছে।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ২০০৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিটির মোট রিজার্ভ রয়েছে ৫৯ কোটি ৬৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ সমাপ্ত হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে। আলোচ্য সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি সমন্বিত আয় (ইপিএস) হয়েছে ৫৩ পয়সা। সমন্বিত শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে ১৩ টাকা ৩৬ পয়সা। আর প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ ’১৯) কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৯ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে ইপিএস ছিল ৪৫ পয়সা। ৩১ মার্চ, ২০১৯ শেষে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে ১৩ টাকা ৪৫ পয়সা। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের উদ্যোক্তা পরিচালদের কাছে ৪১ দশমিক ৫৪ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ২৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে ১ দশমিক ৩১ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে ৩০ দশমিক ৩০ শতাংশ রয়েছে।
বিআইএফসি’র নানা অনিয়ম : বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেড দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়মের জড়িয়ে পড়েছে। এতোদিন গোপন রাখলেও অডিটর প্রতিষ্ঠান কোম্পানিটির নানা অনিয়ম নিয়ে আপত্তি তুলেছে। নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অমান্য করে ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। একই সঙ্গে কোম্পানিটি পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি অর্থ বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেছে। এতে ১৯৯৩ সালের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্সস্টিটিউট অ্যাক্ট এর সেকশন ১৬ লঙ্ঘন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
একই সঙ্গে কোম্পানির ক্যাপিটাল অ্যাডিক্যুইসি রেশিও (সিএআর) এবং রিক্স ওয়েটেড রেশিও থেকে কোর ক্যাপিটাল রেশিও নেগেটিভ হয়েছে। আর তা যথাক্রমে ৭৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ এবং ৮০ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত হিসাব হিসাব অনুযায়ী, গত তিন বছরের শেয়ারে বিনিয়োগের কারণে কোম্পানিটি নিট লোকসানের পরিমাণ ২০ কোটি ৫৫ লাখ ৭৩ হাজার ৯৫১ টাকা। তাছাড়া সম্পদ পুনঃর্মূল্যায়ন রিজার্ভের ওপর কোম্পানিটি তার ডেফার্ড ট্যাক্স ৪০ কোটি ৩৪ লাখ ২৫ হাজার ৬৬৭ টা পরিশোধ করেনি।
নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোম্পানির মোট বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ (ঋণ, লিজ এবং অগ্রিম) ৮৪১ কোটি ৪৮ লাখ ২১ হাজার ৭৫৭ টাকার মধ্যে সানম্যান গ্রুপের কাছে ৬৩৯ কোটি ৬৫ লাখ ৫৪৬ টাকা, যা মোট ঋণের ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ। তবে এই ঋণ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ এসব ঋণ এখন কু-ঋণে পরিণত হয়েছে। যদিও কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট ঋণ কাভার করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেছে। এদিকে বিশ্বাস গ্রুপের কাছে কোম্পানিটির ২০ কোটি ১১ লাখ ৫৫ হাজার ২৬৮ টাকা ঋণও রয়েছে হুমকির মুখে, যা মোট ঋণের ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এর মধ্যে ১ দশমিক ৩০ শতাংশ চলতি বছরে আদায় করা সম্ভব। এ ঋণ আইন অনুযায়ী আদায় করার চেষ্টা চলছে।
বিআইএফসি ২০০৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিটির মোট পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৭৬৯ কোটি ১৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ সালের সমাপ্ত হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোন লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি। আলোচ্য সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১৩ টাকা ৫ পয়সা। শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে ৭৯ টাকা ৪৫ পয়সা (নেতিবাচক)। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১ টাকা ৭১ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে লোকসান ছিল ১ টাকা ৯২ পয়সা। চলতি বছরের ৩১ মার্চ শেষে কোম্পানির শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে ৮১ টাকা ১৬ পয়সা (নেতিবাচক)। কোম্পানির মোট শেয়ারের উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে ৩৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৪৮ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে ১৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ রয়েছে ।
ফার্স্ট ফাইন্যান্সের ঋণ জালিয়াতি: অভিযোগ উঠেছে সমস্যার জর্জরিত ও দীর্ঘদিন ধরেই শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দিতে না পারা কোম্পানি ফার্স্ট ফাইন্যান্সেরও বিরুদ্ধে। কোম্পানিটি তার এক পরিচালকের ঋণ প্রদানে অনিয়ম করেছে বলে নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। নিরীক্ষকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ফার্স্ট ফাইন্যান্স কর্তৃপক্ষ শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন ছাড়াই এক পরিচালককে ৭০ লাখ টাকা ঋণ প্রদানের অনুমোদন দিয়েছে। তবে এ বিষয়ে আগামী বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে লোকসানের মধ্যে নিমজ্জিত থাকা এবং ২০১৬-১৭ সালের বার্ষিক সাধারণ সভা করতে না পারা এ কোম্পানিটির সঞ্চিতি ঘাটতি নিয়েও আপত্তি রয়েছে নিরীক্ষকের।
কোম্পানিটির ২০১৮ সালের আর্থিক হিসাব নিরীক্ষায় উঠে এসেছে, ফার্স্ট ফাইন্যান্সের প্রদত্ত লিজ, ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে সঞ্চিতি ঘাটতি রয়েছে ৪৬ কোটি টাকা, যা সমন্বয়ের জন্য কোম্পানিটিকে ২০২০ সাল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর সময় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ সমাপ্ত হিসাব বছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানিটির মোট ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ ৯৬ কোটি ১৯ লাখ ৮৩ হাজার ৩৮২ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫২ কোটি ১৫ লাখ ৫ হাজার ৬৮৫ টাকা। এর সঙ্গে আরও ২ কোটি অন্য সম্পদ মিলে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়ায় ৪৬ কোটি ৫ লাখ টাকা। কোম্পানির এফআইসিএল স্টেটমেন্ট ও জেনারেল লেজারে লিজ, ঋণ ও অগ্রিমের তথ্যে ২০ কোটি ৫৮ লাখ ৪ হাজার ১৩৯ টাকার পার্থক্য রয়েছে, যা সমন্বয়ের জন্য ফার্স্ট ফাইন্যান্স বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তিন বছর সময় পেয়েছে। এ সময় শুরু হয়েছে চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে।
এদিকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ক্যাশ রিজার্ভ রিকোয়ারমেন্ট (সিআরআর) ঘাটতির জন্য ফার্স্ট ফাইন্যান্স ২০ লাখ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংককে জরিমানা দিয়েছে। এরপরে একই বছরের জুলাই মাসে সিআরআর ঘাটতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক পুনরায় কোম্পানিটিকে ৬২ লাখ ৩৮ হাজার টাকা জরিমানার শাস্তি দেয়। তবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ওই জরিমানা মওকুফের জন্য আবেদন করে এবং শাস্তির বিপরীতে ১০ লাখ টাকা সঞ্চিতি গঠন করেছে।
৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ সমাপ্ত হিসাব বছরের প্রদিবেদন অনুযায়ী কোম্পানির মোট বিনিকৃত সম্পদের পরিমাণ ৮৭৯ কোটি ৪০ লাখ ৫১ হাজার ৭৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৯৫৫ কোটি ৪৭ লাখ ৩৯ হাজার ৪৯০ টাকা। আলোচ্য বছরে বিলম্বিত সুদের ব্যয় ছিল ৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা গত বছর ছিল ১৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ওই বছরে কোম্পানির সারপ্লাস ছিল ৬৯ লাখ ১৭ হাজার টাকা, যা গত বছর ঘাটতি ছিল ৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। রিলেটেড পার্টি ট্রান্সজেকশন ছিল ৫০ লাখ ৬৬ হাজার টাকা, যা গত বছর ঘাটতি ছিল ৬৪ লাখ ২৪ হাজার টাকা।
এ প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ ’শেয়ারবাজার প্রতিদিন’-কে বলেন, ‘এসব কোম্পানিগুলো অনেক দুর্বল। আর্থিকখাতের অবস্থা এমনতেই নেতিবাচক রয়েছে। তাতে দুর্বল কোম্পানিগুলো আরও দুর্বল হয়েছে পড়ছে। এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীরা আগেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সামনে আরও হতে পারেন। কারণ এসব কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের ওপর কারো আস্থা নেই।’
উল্লেখ্য, সম্প্রতি চরম সংকটে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (পিএলএফএসএল) কার্যক্রম বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ প্রেক্ষিতে কোম্পানিটির সাবেক নয় পরিচালক ও দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। নয় সাবেক পরিচালকের মধ্যে তিনজনই শামসুল আলামিন গ্রুপের মালিকপক্ষের। তারা হলেন নার্গিস আলামিন, হুমায়রা আলামিন ও আরেফিন শামসুল আলামিন। শামসুল আলামিন গ্রুপের ব্যবসা ছড়িয়ে রয়েছে আবাসন, স্পিনিং, চামড়াসহ বিভিন্ন খাতে। তাদের কাছে পিপলসের পাওনা ৭৪ কোটি টাকা।
বাকি ছয় সাবেক পরিচালকের মধ্যে এম মোয়াজ্জেম হোসেন বর্তমানে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের পরিচালক ও মতিউর রহমান সাবেক পরিচালক। বর্তমানে মতিউর রহমানের স্ত্রী কামরুন নাহার ব্যাংকটির পরিচালক। পিপলসে মোয়াজ্জেম হোসেনের বর্তমানে কোনো দেনা নেই। মতিউর রহমানের কাছে ৮৪ কোটি টাকা পায় পিপলস লিজিং।
বাকি চার সাবেক পরিচালক হলেন, ইউসুফ ইসমাইল, বিশ্বজিত কুমার রায়, খবিরউদ্দিন মিয়া ও এম শহীদুল হক। এর মধ্যে খবির উদ্দিনের কাছে পিপলসের পাওনা প্রায় ১০০ কোটি টাকা ও বিশ্বজিত কুমার রায়ের কাছে প্রায় ২ কোটি টাকা।
সাবেক দুই কর্মকর্তা হলেন, সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কবির মোস্তাক আহমেদ ও সাবেক মহাব্যবস্থাপক নিপেন্দ্র চন্দ্র পণ্ডিত। তাদের কাছে পিপলসের পাওনা যথাক্রমে ১৪ কোটি ও দেড় কোটি টাকা।
১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিপলস লিজিংকে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের কাছ থেকে মেয়াদি আমানত ও বিভিন্ন ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা ধার করে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির আমানত ছিল ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। আর ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপিই ৭৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের হার ৬৬ শতাংশ। ২০১৫ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে লোকসান গুনছে প্রতিষ্ঠানটি। খেলাপি প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা আদায় করতে না পারায় আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।
ইতোমধ্যে অবসায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে একজন অবসায়ক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক এম আসাদুজ্জামান খান এ দায়িত্ব পালন করবেন। ইতোমধ্যে কোম্পানিটির লেনদেনও উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ স্থগিত করেছে। কোম্পানিটির অবসায়নের ঘোষণায় পুরো আর্থিকখাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন/এসএ/খান

Share
নিউজটি ৪৮০ বার পড়া হয়েছে ।
Tagged