নুরুজ্জামান তানিম/নাজমুল ইসলাম ফারুক:
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তাদের বিধিমালা, ১৯৮৭ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। ‘সিকিউরটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ ১৯৬৯’-এর (xvii) এর ৩৩ ধারা অনুযায়ী এ বিধিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে বিধিমালাটির একটি খসড়া প্রস্তাবনা তৈরি করেছে কমিশন। এর নামকরণ করা হয়েছে ‘সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বিধিমালা, ২০১৯’। খসড়া প্রস্তাবে স্টক এক্সচেঞ্জের বার্ষিক ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। বছর শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যে এ ফি পরিশোধে ব্যর্থ হলে স্টক এক্সচেঞ্জকে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা গুনতে হবে। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাধ্যমে এ ধরনের বার্ষিক ফিসহ জরিমানার আদায়ের বিধান না থাকায় বিষয়টি নিয়ে দ্বি-মত পোষণ করেছে স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ।
ইতোমধ্যে গত ২০ আগস্ট বিধিমালাটির খসড়া প্রস্তাবের ওপর বিএসইসি-তে একটি পরামর্শমূলক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই কর্মশালার আলোকে স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্রোকারেজ হাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংকার্স, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির প্রতিনিধিসহ পুঁজিবাজারের স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে পরামর্শ চেয়েছে কমিশন। ওই পরামর্শ অনুযায়ী শিগগিরই বিধিমালাটির খসড়া প্রস্তাব জনমত যাচাইয়ের জন্য প্রকাশ করা হবে।
জানা গেছে, বিধিমালাটির ওপর পরামর্শ চাওয়ার প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। এর ধারাবাহিকতায় আজ রোববার ‘ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (ডিবিএ) তাদের সদস্যদের সঙ্গে বিধিমালাটি নিয়ে আলোচনা করার কথা রয়েছে। সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে আগামী ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডিবিএ’র পক্ষ থেকে বিএসইসি’র কাছে এ বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হবে। এছাড়া ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই), বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ), অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেটড কোম্পানিজ (বিএপিএলসি) নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের পরামর্শ বিএসইসি- কে জানাবে।
এ বিষয়ে ডিএসই’র পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন ‘দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন’-কে বলেন, ‘বাজারের স্বার্থে বিএসইসি বিধিমালা সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব প্রণয়ন করেছে। প্রস্তাবনাটির ওপর ডিএসইর মতামত চেয়েছে কমিশন। এ বিষয়ে ডিএসইর পর্ষদে আলোচনা করা হবে। আলোচনার সাপেক্ষে কমিশনকে মতামত দেয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের আলোকে কমিশন বাস্তবসম্মত একটি বিধিমালা প্রণয়ন করবে বলে আশা প্রকাশ করছি।’
এদিকে, সিএসই’র ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম ফারুক ‘দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন’-কে বলেন, ‘বিএসইসির প্রণয়ন করা খসড়া বিধিমালাটির প্রস্তাবের আলোকে আলোচনা করেছে সিএসই। এ বিষয়ে পর্ষদে আলোচনা করা হবে। পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘খসড়া প্রস্তাবে স্টক এক্সচেঞ্জের বার্ষিক ফি ২০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা বিএসইসির সঙ্গে আলোচনা করব।’
এছাড়া বিএমবিএ-এর মহাসচিব খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদ ‘দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন’-কে বলেন, ‘বিএসইসির প্রস্তাবনাটি পর্যালোচনা করে শিগগিরই মতামত দেয়া হবে।’
প্রস্তাবিত খসড়া সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বিধিমালা, ২০১৯ এ বেশ কিছু বিষয় সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা হয়েছে। বিশেষ করে স্টক এক্সচেঞ্জের রেজিস্ট্রেশন, নবায়নের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে- প্রত্যেক বছর স্টক এক্সচেঞ্জের রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন ফি বাবদ কমিশনকে ৫ লাখ টাকা দিতে হবে, যা অফেরতযোগ্য। একইসঙ্গে স্টক এক্সচেঞ্জকে রেজিস্ট্রেশনের সনদ নিতে ১ কোটি টাকা পে অর্ডার বা ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে জমা দিতে হবে। তাছাড়া প্রতি বছর বার্ষিক ফি বাবদ স্টক এক্সচেঞ্জকে ২০ লাখ টাকা জমা দিতে হবে। যদি কোনো স্টক এক্সচেঞ্জ বছর শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যে বার্ষিক ফি জমা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে প্রতিদিন আরও ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা গুনতে হবে।
প্রস্তাবিত বিধিমালায় বিভিন্ন সংজ্ঞার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। এছাড়া বিধিমালায় স্টক ব্রোকার ও স্টক ডিলার প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে- স্টক ব্রোকার ও স্টক ডিলারদের নেট ক্যাপিটাল ব্যালেন্সের প্রতিবেদন প্রত্যেক মাস শেষ হওয়ার তিন কার্যদিবসের মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জে জমা দেবে। আর স্টক এক্সচেঞ্জ সাত কার্যদিবসের মধ্যে তা কমিশনে দাখিল করবে বলে প্রস্তাবিত খসড়ায় উল্লেখ করা হয়। একইসঙ্গে স্টক ব্রোকার ও স্টক ডিলারের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বেশ কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিধিমালায় স্টক ব্রোকার ও স্ট্রক ডিলারদের আর্থিক হিসাব প্রণয়নে ও নিরীক্ষা কার্যক্রমে কিছু পরিবর্তন আসছে। এর মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জ একটি নিরীক্ষক প্যানেল গঠন করবে। প্রত্যেক স্টক ব্রোকার ও ডিলাররা বার্ষিক হিসাব প্রণয়ন করে ওই প্যানেল নিরীক্ষকদের দিয়ে হিসাব নিরীক্ষা করাতে হবে। হিসাব বছর শেষ হওয়ার চার মাস বা ১২০ দিনের মধ্যে কমিশনে তা দাখিল করতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ডস (আইএফআরএস) অনুযায়ী প্রত্যেক স্টক ব্রোকার ও ডিলার আর্থিক হিসাব প্রস্তুত করবে।
স্টক ডিলার ও স্টক ব্রোকারের কনসোলিডেটেড কাস্টমার অ্যাকাউন্টস পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রমে পরিবর্তন আনছে। এরমধ্যে স্টক ব্রোকার ও স্টক ডিলার তাদের অফিস বা শাখা অফিসে একাধিক কনসোলিডেটেড কাস্টমার অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে না। একইসঙ্গে এ অ্যাকাউন্ট কোনো ব্যক্তির নিকট দায়বদ্ধ রাখা যাবে না।
স্টক ডিলার ও স্টক ব্রোকারের নিজস্ব অ্যাকাউন্টস পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রমের বিষয়ে বলা হয়েছে- প্রান্তিক হিসাব শেষে ১৫ দিনের মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। স্টক ব্রোকার ও ডিলারদের নিজস্ব হিসাব থেকে বৈধ কার্যক্রমে ফান্ড বিনিয়োগ করা যাবে না।
এছাড়া প্যানেল নিরীক্ষকদের কোনো অসঙ্গতি পেলে কমিশন তা ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)- কে জানাবে। আইসিএবি যদি অভিযুক্ত নিরীক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয় তাহলে কমিশন বিষয়টি দেখবে। স্পেশাল অডিটের কার্যক্রম কি হবে সে বিষয়গুলো প্রস্তাবিত বিধিমালায় কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ট্রেকহোল্ডাদের জন্য যদি কোনো নিরীক্ষকের প্রয়োজন হয়, সেটা কমিশন নিয়োগ দেবে। কিন্তু তাদের খরচ ট্রেকহোল্ডার বহন করবে।
এবিষয়ে বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান এর সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন/এসএ/খান