সাইফুল শুভ : কাঁচা চামড়ার মৌসুমেও কর্মহীন ও অলস সময় পার করছে ‘অ্যাপেক্স ট্যানারি’র শ্রমিকরা। গত ছয় মাসে ভালো ব্যবসা করতে পারেনি কোম্পানিটি। ফলে আলোচ্য সময়ে প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) কমেছে। তবে প্রথম প্রান্তিকে ইপিএস বেশি দেখিয়ে শেয়ারের দর বাড়ানোর অভিযোগও রয়েছে। ‘অ্যাপেক্স ট্যানারি’র আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা ও সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরীতে অবস্থিত কোম্পানির কারখানা সরেজমিনে পরিদর্শন করে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত বৃহস্পতিবার অ্যাপেক্স ট্যানারির কারখানা পরিদর্শনে গেলে কোম্পানির সচিব সুশান্ত কুমার সাহা প্রথমেই কথা না বলে হঠাৎ কারখানা পরিদর্শনে আসার কারণ জানতে চাইলেন। নানা প্রশ্নে জর্জরিত করার পর অবশেষে কারখানায় প্রবেশের অনুমতি দেন তিনি।
ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, হাতেগোনা ৮ থেকে ১০ জন শ্রমিক কাজ করছে। আবার আরেকটি ফ্লোরে গিয়ে দেখা যায়- শ্রমিকরা শুয়ে আছেন। ঈদ-উল আযহার পর ট্যানারিগুলো ব্যস্ত সময় কাটালেও অ্যাপেক্স ট্যানারির চিত্র ভিন্ন। ভবনের নিচতলায় চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার মেশিনগুলোর ৭৫ শতাংশই বন্ধ রয়েছে। সেখানে শুধু একজন শ্রমিককে ঘুরাফেরা করতে দেখা গেছে। অধিকাংশ মেশিন বন্ধ থাকায় শ্রমিকের ভিড়ও নেই।
দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো শ্রমিকই কাজের মধ্যে নেই। দু’একজন শ্রমিক হাঁটাহাঁটি করছে। আর দু’জন শ্রমিক ফ্লোরে শুয়ে আছেন। কোনো সিকিউরিটির লোক (নিরাপত্তা কর্মী) বা ফ্লোর ইনচার্জ কাউকেই পাওয়া যায়নি।
এরপর তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, প্রক্রিয়াজাতকৃত চামড়ার স্তূপ রয়েছে। এই ফ্লোরের এক কোনায় ৫ থেকে ৬ জন শ্রমিক কাজ করছে। ছবি তুলতে গেলে একজন এসে জানতে চাইলেন। সাংবাদিক পরিচয় দিলে আর কথা না বলে চলে যান।
এরপর কোম্পানির অফিস ফ্লোরে গিয়ে কোম্পানি সচিবের জন্য অপেক্ষা। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসলেন কোম্পানি সচিব সুশান্ত কুমার সিনহা। কোরবানী ঈদে কোম্পানি সরাসরি কাঁচা চামড়া কিনেছে কি না Ñজানতে চাইলে ‘মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার অনুমতি নেই’ বলে জানান তিনি। এরপর সব প্রশ্নই এড়িয়ে যান তিনি। চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার বা সিএফওর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চাইলে সুশান্ত কুমার জানান, তারও কথা বলার নিষেধাজ্ঞা আছে। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের বাইরে কেউ কথা বলতে পারবে না বলে জানান তিনি।
এদিকে অ্যাপেক্স ট্যানারির আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, কোম্পানি প্রথম প্রান্তিকে ইপিএস দেখানো হয়েছে ৪৮ পয়সা দেখিয়েছে। এর পরের দুই প্রান্তিকে সেটির আর ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি। দ্বিতীয় প্রান্তিকে ইপিএস দাঁড়িয়েছে ১১ পয়সা। সর্বশেষ তৃতীয় প্রান্তিকে ধস নেমে এসেছে। এবার ইপিএস দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ পয়সা।
তবে কোম্পানিটি প্রথম প্রান্তিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ইপিএস বেশি দেখিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত বছরের ১৪ নভেম্বর প্রথম প্রান্তিক ঘোষণার পর কোম্পানির শেয়ারের দর ১৩৮ টাকা থেকে বেড়ে দুই মাসের ব্যবধানে ১৫৩ টাকায় ওঠে আসে।
এরপর চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি দ্বিতীয় প্রান্তিক ঘোষণার পর থেকে আবার কমতে থাকে। তৃতীয় প্রান্তিকের পর সেটির দাম এখন নিম্নমুখী। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ১২৭ টাকা ৮০ পয়সায় নেমে এসেছে। এটি এক বছরের সর্বনিন্ম দর।
অন্যদিকে অ্যাপেক্স ট্যানারির শেয়ারের দর কমার পরও অতি মূল্যায়িত রয়েছে। বর্তমানে (২২ আগস্ট পর্যন্ত) নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী মূল্য ও আয়ের অনুপাত (পিই রেশিও) ১৪৭.৪৬। আর অ-নিরীক্ষিত প্রতিবেদন অনুযায়ী পিই ৫০.৫১।
এছাড়া কোম্পানি শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভি) কমেছে। সর্বশেষ অ-নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী এনএভি ৬৮ টাকা ১৩ পয়সা। অথচ ৩০ জুন ২০১৮ তে এনএভি ছিল ৭২ টাকা ২৪ পয়সা।
এসব বিষয়ে কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। কোম্পানির অন্যতম পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুরকে তার মোবাইলে ফোন করে এবং খুদে বার্তা পাঠানোর পরও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)-এর সাবেক সভাপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ ‘দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন’-কে বলেন, ‘কোম্পানির অ-নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে যদি কেউ বাড়িয়ে দেখায় এটি ধরার কোনো উপায় নেই। এটি একমাত্র নৈতিকতার অভাবেই হয়ে থাকে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে নৈতিকতা বাড়াতে হবে। ম্যানেজমেন্ট ও পর্ষদ যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য দেয়- তাহলে এটি ধরার কোনো উপায় নেই।’
বিগত ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে অ্যাপেক্স ট্যানারি ৪০ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। সর্বশেষ ৩০ জুন অনুযায়ী কোম্পানির পরিচালকদের কাছে ৪৩.০৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৩৫.০৭ শতাংশ এবং ২১.৮৮ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন/এসএ/খান