আইন করে সুদহার নির্ধারণ করার ফল ভালো হবে না – ড. আহসান এইচ মনসুর

সময়: রবিবার, ডিসেম্বর ২২, ২০১৯ ৯:৪৭:৩৮ পূর্বাহ্ণ


বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক পলিসি রিচার্স ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) বলেছেন, আইন করে ব্যাংকের সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করার ফল ভালো হবে না। এতে উল্টোটাও হতে পারে। সম্প্রতি দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আমাদের ডেপুটি এডিটর এম এ খালেক

দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : জানুয়ারি, ২০২০ থেকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার জন্য অর্থমন্ত্রী প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এ উদ্যোগ কতটা কার্যকর টেকসই হবে বলে মনে করেন?
ড. আহসান এইচ মনসুর : আইন করে সরকার অনেক কিছুই ঘোষণা করতে পারেন। কিন্তু আইন করে সুব্যবস্থা করা যায় না। আমরা ইদানিং কি দেখলাম? যখন পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেল। তখন পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য র‌্যাব নামানো হলো। এতে ফল হলো উল্টো। পেঁয়াজ বাজার থেকে উধাও হয়ে গেল। বাজারে পেঁয়াজের দাম আরো বেড়ে গেল। বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ অনেকটাই কমে গেল। আইন করে আমরা যদি ব্যাংকিং সেক্টরের হাত-পা বেঁধে দিই তাহলে কি হবে? ব্যাংকগুলো ঋণদানের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় আনরেজিস্ট্রার্ড ব্যাংকিং ব্যবসায় চালু হয়ে গেছে। কৃষি ঋণের ক্ষেত্রে এটা হয়েছে। এ অবস্থা হলে সেটা দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য আরো বড় ধরনের বিপদ নিয়ে আসবে। ডেসটিনি-যুবকের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য আরো ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠান ব্যাংক না হয়েও ব্যাংকের মতো আমানত সংগ্রহ করা তো। অস্বাভাবিক উচ্চহারে সুদ প্রদানের আশ^াস দিতো। তাদের সেই আশ^াসে বিশ^াস স্থাপন করে অনেকেই ডেসটিনি এবং যুবকের সঙ্গে লেনদেন করেছে। পরবর্তীতে তাদের অবস্থা কি হয়েছে আমরা তা সবাই জানি। কাজেই ব্যাংকিং সেক্টরে সুদের হার জোর করে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ কখনোই ভালো ফল দিতে পারে না। কারণ এ অবস্থায় মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ধরনের ব্যবসায়ের প্রসার ঘটবে। বাজার ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়েই সুদের হার কমাতে হবে। এ কাজটি একদিনে সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে ব্যাংকিং সেক্টরের সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে। ব্যাংকগুলোর তারল্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। মোট কথা ব্যাংকিং সেক্টরে সুস্থ্য পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। হংকং এর লোন লস্ হচ্ছে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। আমাদের লোন লস্ হচ্ছে ১১ দশমিক ৫শতাংশ। এটা তো বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব। আসলে আমাদের লোন লস্রে হার হচ্ছে ২৩ দশমিক ৫শতাংশ। কোথায় শূন্য দশমিক ৫ আর কোথায় ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ। আমাদের দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা আজ কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে তা এ থেকেই অনুধাবন করা যেতে পারে। সরকারি হিসাব মতে, আমাদের ইনফ্লেশনের হার হচ্ছে সাড়ে ৫-৬ শতাংশ। ওদের ইনফ্লেশন হচ্ছে ২ শতাংশ। আমাদের দেশের পুরো ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থার উপর দৃষ্টি দিতে হবে। সেখানেই সংস্কার করতে হবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো একটি স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে চলে এলে সুদের হার এমনিতেই কমে আসবে। ইনফ্লেশন রেট কমিয়ে আনতে হবে। এক্সচেঞ্জ রেট স্ট্যাবল রাখতে হবে। ঋণদান যোগ্য তহবিলের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টকে শক্তিশালী করতে হবে। ঋণদান যোগ্য তহবিলের পরিমাণ বেড়ে গেলে এমনিতেই সুদের হার কমে আসে। ২০১৬-’১৭ সালে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ঋণদানযোগ্য তহবিলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবার ফলে তখন সুদের হার এমনিতেই সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে এসেছিল।

দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : প্রত্যেক দেশের শেয়ারবাজারেই উত্থান-পতন থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের শেয়ারবাজার অস্বাভাবিক উত্থান-পতন ঘটছে। এর কারণ কি বলে মনে করেন?
ড. আহসান এইচ মনসুর : আমি মনে করি, বর্তমানে আমরা দেশের শেয়ারবাজারে যে অস্থিরতা লক্ষ্য করছি তা দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরের সামগ্রিক অস্থিরতারই প্রতিফলন। সামগ্রিক অর্থনৈতিক সেক্টরে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? করপোরেট সেক্টর বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। করপোরেট সেক্টর বলতে আমি সবধরনের করপোরেট সেক্টরকেই বুঝাচ্ছি। ব্যাংকিং সেক্টর নিজেও একটি করপোরেট সেক্টর। ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা মোটেও ভালো নেই। আমরা যদি ব্যাংকিং সেক্টরের স্টকগুলোর দাম প্রত্যক্ষ করি তাহলে কি দেখতে পাই? ৫-৬ বছর আগে ব্যাংকিং সেক্টরের স্টকগুলোর যে দাম ছিল এখন তা অস্বাভাবিকভাবে কমে এসেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ফেইজ ভ্যালুর কাছাকাছি চলে এসেছে অথবা নিচে নেমে গেছে। সিমেন্ট সেক্টর বা অন্য যে কোনো ইন্ডাস্ট্রির কথাই বলি না কেন সেখানে তারল্য সঙ্কট এবং আর্থিক সমস্যা আছে। তৈরি পোশাক সেক্টরে নানা সমস্যা আছে। বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক সেক্টরের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বেড়ে যাচ্ছে। শ্রমিক-কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধা যেভাবে বাড়ছে উৎপাদনশীলতা সেভাবে বাড়ছে না। ফলে এক ধরনের সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। সেই তুলনায় বিদেশ থেকে আমরা তৈরি পোশাক রফতানির জন্য অর্ডার পাচ্ছি না। সবকিছু মিলিয়ে আমরা এক ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছি। এ চাপের প্রতিফলনও কিন্তু শেয়ারবাজারে পড়ছে। আর একটি বড় বিষয় হচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টরে তারল্য সঙ্কট থাকলে শেয়ারবাজারে তারল্য থাকতে পারে না। কারণ অনেকেই আছেন যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বা অন্য কোনো প্রকারের অর্থ সংগ্রহ করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন। শেয়ারবাজারের বিনিয়োগযোগ্য অর্থ ব্যাংক থেকেই আসে। ব্যাংকিং সেক্টরে যেহেতু এখন তারল্য সঙ্কট রয়েছে তাই বিনিয়োগকারীরা সেখান থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ কার্যক্রম অনেক ব্যাংকই সংযত রাখছে। অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরৎ দিতে পারছে না। সর্বশেষে বলবো, গত কয়েক বছরে বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ার আসেনি। বরং খারাপ কোম্পানির শেয়ারবাজারে এসেছে। এতে বাজারের অবস্থা ভালো হবার পরিবর্তে খারাপ হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো শেয়ার ফেইস ভ্যালুর চেয়ে কম দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এমন তো হবার কথা নয়। এখানে নীতি নির্ধারকদের একটি দায়িত্ব আছে। তারা সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছেন বলে মনে হয় না। যেসব আইপিও বাজারে আসছে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আর্থিক অবস্থা কেমন, তাদের পরিচালন কার্যক্রম কেমন, মৌলভিত্তি কেমন, কোম্পানির ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক পরিকল্পনা এসব জেনেই তো আইপিও প্রাইস ঠিক করা হচ্ছে। তারা বিভিন্ন কোম্পানির আইপিও রেট নির্ধারণ করছেন তা কতটা সঠিক হচ্ছে এটা বিবেচনা করতে হবে। কোম্পানি আইপিও রেট নির্ধারণের সময় যেসব তথ্য-উপাত্ত পেশ করে তা কতটা সত্যি এবং তথ্যনির্ভর তা যাচাই করে দেখতে হবে। আইপিও রেট নির্ধারণের আগে এসব মৌলিক তথ্য যদি ঠিক মতো যাচাই করা না হয় তাহলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হতে পারেন। বর্তমানে আমরা তেমন একটি বিষয়ই লক্ষ্য করছি। দুর্বল কোম্পানির আইপিওগুলো অতিমূল্যায়িত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : শেয়ারবাজারের বর্তমান যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে একজন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন?
ড. আহসান এইচ মনসুর : প্রথমেই আমি একটি বিষয় বলতে চাই তাহলো, স্টক মার্কেট কিন্তু ছোটখাটো বিনিয়োগকারীদের জন্য নয়। কাজেই যারা অতি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী তাদের শেয়ারবাজার থেকে সরে আসাই উচিৎ। যারা বড় বিনিয়োগকারী বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী তারা স্টক মার্কেটে থাকবেন। যারা বড় বিনিয়োগকারী তারা বুঝে শুনেই বিনিয়োগ করেন। কাজেই তাদের ব্যাপকভাবে লোকসান দেবার আশঙ্কা কম থাকে। ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম ঠিকই আছে। এগুলোতে বিনিয়োগ করলে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না বললেই চলে। যেমন- গ্রামীণফোন, ব্র্যাক ব্যাংক এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম কিন্তু খুব একটা বাড়ে কমে না। এসব কোম্পানির শেয়ার প্রাইস অনেকটাই স্থিতিশীল থাকে। বাজারে এসব কোম্পানির শেয়ারের দামও সবচেয়ে বেশি। এসব কোম্পানিও মাঝেমধ্যে কিছুটা চাপে পড়ে কিন্তু তা ততটা ব্যাপক নয়। বাজারে ভালো স্টক ধরে রাখতে হবে। ভালো স্টক সব সময়ই ভালো ডিভিডেন্ড দেয়। কাজেই ভালো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা হলে তা নিয়ে চিন্তিত হবার কিছু নেই। কিন্তু ফটকাবাজ স্টক যেগুলো আজকে আছে কালকে নেই তেমন শেয়ারে বিনিয়োগ করলে ক্ষতির আশঙ্কা প্রবল। কোম্পানির ফ্যাক্টরি বন্ধ কিন্তু বাজারে শেয়ারের দাম বাড়ছে এমন শেয়ারে বিনিয়োগ করলে নিশ্চিত ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে। এ ধরনের কোম্পানির শেয়ারে যারা বিনিয়োগ করবেন তারা নিজেরাই তাদের পরিণতির জন্য দায়ী।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : একজন নতুন বিনিয়োগকারী যখন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে যাবেন তার জন্য কোম্পানির মৌলভিত্তিগুলো সম্পর্কে জানা কতটা দরকার বলে মনে করেন?
ড. আহসান এইচ মনসুর : একটি কোম্পানির প্রকৃত আর্থিক অবস্থা না জেনে না শুনে বিনিয়োগ করতে যাওয়াটা একেবারেই অনুচিৎ এবং নির্বুদ্ধিতার কাজ। আরো একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, শেয়ারবাজার অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি ক্ষেত্র। কারো কথায় প্রভাবিত হয়ে এখানে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মোটেও ঠিক নয়। শেয়ারবাজারে হুজুগের কোনো স্থান নেই। সাধারণ বিনিয়োগকারী যদি স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করতে চান তাহলে তার পর্যাপ্ত পরিমাণ উদ্বৃত্ত অর্থ থাকতে হবে। যাতে কোনো কারণে একটি শেয়ারের দরপতন ঘটলে তিনি সে কোম্পানির শেয়ার লোকসানে বিক্রি করে দিয়ে ধরে রাখতে পারেন। শেয়ার ধরে রাখলে এক সময় না এক সময় দাম বাড়বেই। কিন্তু এ জন্য উদ্বৃত্ত অর্থ থাকা এবং ধৈর্য ধারণ করতে হবে। কারো নিকট থেকে অর্থ ধার করে এনে বিনিয়োগ করা কোনোভাবেই ঠিক নয়। আমি বলি এটা নিন্দনীয় কাজ। শেয়ারবাজার বিনিয়োগ করতে হলে নিজের পর্যাপ্ত পরিমাণ উদ্বৃত্ত অর্থ থাকতে হবে। নিজের পর্যাপ্ত পরিমাণ উদ্বৃত্ত অর্থ না থাকলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে যাওয়াটা এক ধরনের লোভ বলেই আমি মনে করি। এ ধরনের লোভ করতে না যাওয়াটাই উচিৎ। যাদের পকেটে অনেক টাকা আছে, ভালো ব্যাংক ব্যালেন্স আছে ৫ বছর টাকা শেয়ারবাজারে ফেলে রাখলেও কোনো অসুবিধা হতে না তারাই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারেন। তাও ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে। যেনতেনো শেয়ারে বিনিয়োগ করলে দীর্ঘদিনেও মুনাফার মুখ দেখার সম্ভাবনা কম থাকে। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি যার উদ্বৃত্ত টাকা আছে তিনিই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারেন তাও ভালো মৌলভিত্তি সম্বলিত কোম্পানির শেয়ারে। এমন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে যাদের মালিকানা নিয়ে কোনো সঙ্কট নেই। বাজারে সুনাম আছে। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কোম্পানির পণ্যের শক্ত অবস্থান রয়েছে। নিকট অতীতে কোম্পানিটি ভালো ডিভিডেন্ড দিয়েছে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার আগে অবশ্যই ভালোভাবেই যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে। কোনো কারণেই অন্যের কথায় বা কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিনিয়োগ করা ঠিক নয়। ভালোভাবে যাচাই করে বিনিয়োগ করলে লাভবান হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : ব্যক্তি খাতের ভালো ভালো কোম্পানি প্রত্যাশা মতো শেয়ারবাজারে আসছে না। এর কারণ কী এবং কীভাবে এসব কোম্পানিকে বাজারে নিয়ে আসা যায় বলে মনে করেন?

ড. আহসান এইচ মনসুর : সামগ্রিকভাবে শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা না থাকায় বড় এবং ভালো কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে আসছে না। আমি মনে করি, যারা বড় ও ভালো কোম্পানি তাদের নিজেদের স্বার্থের বাজারে আসা উচিৎ। আর সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। বড় কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারের অস্থিতিশীলতা দেখে ভয় পান। তারা মনে করছেন, শেয়ারবাজারে গেলে আবার কোন সমস্যায় পড়ি। আমি নিজেও ওয়ালটনের মতো কোম্পানিকে বাজারে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করেছি। তারা বাজারে আসতে চাচ্ছে। ওয়ালটনের মতো স্বনামধন্য কিছু কোম্পানিকে আমরা যদি বাজারে নিয়ে আসতে পারি তাহলে অন্যেরাও বাজারে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ হবে। এতে শেয়ারবাজারের অবস্থা ভালো হবে। বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ারের সরবরাহ বাড়নোর কোনো বিকল্প নেই। ভালো কোম্পানির শেয়ার বাজারে এলে বিনিয়োগকারীরাও উৎসাহিত হবেন। গ্রামীণফোনের পর ভালো কোনো কোম্পানির শেয়ার বাজারে আসেনি। সেটা নিশ্চিতভাবেই আমাদের ব্যর্থতা। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষে উচিত হবে ভালো কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করে তাদের বাজারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা। একটি কোম্পানির শেয়ারবাজারে আসতে হলে দু’বছর সময় লেগে যায়। এ কালক্ষেপণ কেন? তাদের কি ৬ মাসের মধ্যে বাজারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা যায় না?
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ২৬টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারবাজারে নিয়ে আসার কথা ছিল। এক সময় প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিতও করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে অজ্ঞাত কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারবাজারে আসেনি। এর কারণ কি?
ড. আহসান এইচ মনসুর : আমি ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী নই। জনগণকে প্রতারিত করার জন্য সরকারের শেয়ারবাজারে যাওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাস্থ্যগত অবস্থাটা কেমন? রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো যদি আর্থিকভাবে শক্তিশালী থাকে তাহলে তারা শেয়ারবাজারে আসতে পারে। কিন্তু দেখা যাবে ‘ঠক বাছতে গা উজার।’ হয়তো দেখা যাবে একটিও ভালো প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাচ্ছে না। আর্থিক ভিত্তি ভালো এমন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের শেয়ারবাজারে নিয়ে আসা যেতে পারে। দুর্বল মৌলভিত্তির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারবাজারে না আনাই ভালো। কারণ এতে বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হতে পারেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার বাজারে না আসার পেছনে মহল বিশেষের স্বার্থ কাজ করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা বোর্ড, চেয়ারম্যান, এমডি এবং কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারিরা নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে এলে সেসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই আশঙ্কায় তারা শেয়ারবাজারে ছাড়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : যেসব সেক্টর করপোরেশন বছরের পর বছর লোকসান দিচ্ছে পর্যায়ক্রমে তাদের শেয়ারবাজারে ছেড়ে দিয়ে ব্যক্তি খাতে হস্তান্তরের কথা শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু এখানেও কোনো অগ্রগতি নেই। কিন্তু কেনো?
ড. আহসান এইচ মনসুর : যেসব রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর লোকসান দিচ্ছে তাদের শেয়ারবাজারে নিয়ে এলে কি হবে তা ভাবতে হবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ শেয়ার যদি সরকারের হাতেই থাকে তাহলে কি লাভ হবে? রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ৪৯ শতাংশ শেয়ার যদি বাজারে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতেই থাকবে। এতে গুণগত কোনো পরিবর্তন হবে না। গুণগত পরিবর্তন না হলে প্রতিষ্ঠানটি ভবিষ্যতেও ক্রমাগত লোকসান দিতেই থাকবে। তাহলে শেয়ারে দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে? জনগণ কিন্তু এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হবে। কাজইে এমন কোম্পানি বাজারে এনে কোনো লাভ নেই। বরং সরকার ইচ্ছে করলে লোকসানদানকারী সেক্টর করপোরেশনগুলোকে ব্যক্তি খাতে হস্তান্তর করে দিতে পারেন। তখন নতুন ম্যানেজমেন্ট চাইলে তাদের প্রতিষ্ঠানের শেয়ারবাজারে নিয়ে আসতে পারেন।

দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন/এসএ/খান

Share
নিউজটি ১১৫৮ বার পড়া হয়েছে ।
Tagged