অনুপ সর্বজ্ঞ : দেশের বেশ কিছু শীর্ষ বীমা কোম্পানির মালিকানায় সম্প্রতি পরিবর্তন এসেছে। অনেকটা চুপিসারে এসব কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ রদ-বদলের কারণে বিষয়টি ‘বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্র্তৃপক্ষ’ (আইডিআরএ)-এরও জানা নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির মতে, এভাবে গোপনে কোনো কোম্পানির মালিকানা বদলের প্রবণতা বিনিয়োগকারী ও গ্রাহক স্বার্থের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এখন থেকে বীমা কোম্পানির পরিচালক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আইডিআরএ’র পূর্বানুমোদন নিতে হবে। শিগগিরই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, ব্যাংক খাতে পরিচালক নিয়োগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ন্যূনতম যোগ্যতার ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোকে পরিচালক নিয়োগের অনুমোদন দেয়। তবে বীমা খাতে পরিচালক নিয়োগে কোনো নীতিমালা না থাকায় অশিক্ষিত, অযোগ্য ও অদক্ষ অনেক পরিচালকের অধীনেই এ খাতের অধিকাংশ কোম্পানির কার্যক্রম চলছে। গোপনে মালিকানা বদল ছাড়াও জোরপূর্বক পরিচালক অপসারণ, স্বাক্ষর জাল করে অন্য পরিচালকের শেয়ার বিক্রিসহ নানা অভ্যন্তরীণ সমস্যায় এ খাতের অনেক কোম্পানিই আজ অস্তিত্ব সংকটে।
এদিকে সংশোধিত আইন অনুযায়ী পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। আইনের ১৫(খ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিশেষায়িত ব্যাংক ছাড়া অন্য সব ব্যাংক-কোম্পানিকে এর পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিযুক্ত অথবা পদায়নের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়া তাদের নিজ পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া, বরখাস্ত করা বা অপসারণ করা যাবে না।’ সংশোধিত আইনের ১৫(ঘ)-এর উপধারা ৬ অনুযায়ী ব্যাংক কোম্পানির পরিচালক হওয়ার জন্য কমপক্ষে ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা বা ব্যবসায়িক অথবা পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
এ বিষয়ে আইডিআরএ’র সদস্য ড. এম মোশাররফ হোসেন ‘শেয়ারবাজার প্রতিদিন’- কে বলেন, ‘কোম্পানিতে কী ঘটছে, নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে তা জানার অধিকার আমরা রাখি। এছাড়া বীমা কোম্পানির সঙ্গে বহু বিনিয়োগকারী ও গ্রাহকের স্বার্থ জড়িত। তাই সবকিছু বিবেচনায় আমরা মনে করছি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে কোন পরিবর্তন আনতে হলে তার পূর্বানুমোদন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা থেকে নেয়া জরুরি। শিগগিরই এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের আদলে বীমা খাতের জন্যও পরিচালক নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়নের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। কারণ অদক্ষ ও অযোগ্যদের পরিচালনায় কোনো খাত কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করতে পারে না।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, ফারইস্ট লাইফের পর্ষদ ২০ সদস্যের। এর মধ্যে গত বছরের ২২ অক্টোবর পদত্যাগ করেছেন ছয় পরিচালক। ছয়জনের মধ্যে প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিদায়ী চেয়ারম্যান এমএ খালেকের পরিবারের স্বার্থ সংশ্লিষ্টই পাঁচজন। ফারইস্ট লাইফের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত পর্ষদ বৈঠকে নতুন ছয় পরিচালক নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এর মধ্যে একজন পরিচালক হলেন সাইফ্যাং সিকিউরিটিজের পরিচালক নাসির বিন জালাল।
এদিকে, দুই স্বতন্ত্রসহ প্রাইম লাইফের পর্ষদ ১৭ সদস্যের। গত নভেম্বর মাসে প্রাইম লাইফের অনুষ্ঠিত পর্ষদ বৈঠকে নতুন আট পরিচালকের নিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এর আগে গত ২৩ অক্টোবর পদত্যাগ করেন চেয়ারম্যানসহ প্রাইম লাইফের আট পরিচালক। প্রাইম লাইফের চেয়ারম্যানও ছিলেন এমএ খালেক।
পদত্যাগকারী পরিচালকদের মধ্যে রয়েছেন কোম্পানির চেয়ারম্যান এমএ খালেক, যিনি ম্যাকসন বে লিমিটেডের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। এমএ খালেকের স্ত্রী পরিচালক সাবিহা খালেক এবং মেয়ে সারওয়াত খালেদও পদত্যাগ করেন।
কোম্পানিটিতে যারা নতুন এসেছেন তারা হলেন- গোমতী টেক্সটাইলের এমডি মো. আখতার, আইডিআরএ’র সাবেক সদস্য সাবেক জেলা জজ মো. ফজলুল করিম, মুহাম্মদ মুনীরুজ্জামান মজুমদার, এটিএম এনায়েতুর রহমান ও আরিফ হোসেন ওরফে রনি। অবশিষ্ট চারজনের মধ্যে নোমান করপোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে নোমান হাসান ভূঁইয়া, এসবি করপোরেশন নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে নাজমুল হাসান ভূঁইয়া, সাইফ্যাং সিকিউরিটিজের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে নাসির বিন জালাল ও স্বতন্ত্র পরিচালক এটিএম এনায়েতুর রহমান। আগে পরিচালক ছিলেন এবং এখনো আছেন, তাদের মধ্যে দু’জন ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের আত্মীয়।
এদিকে ২০১২ সালে নতুন অনুমোদন পাওয়া বীমা কোম্পানিগুলোর অনেক উদ্যোক্তা-পরিচালকই তাদের শেয়ার ছেড়ে দিয়েছেন। কোনো কোনো উদ্যোক্তা-পরিচালক এখন কেবল শেয়ারহোল্ডার হিসেবে কোম্পানিতে আছেন। অনেকে আবার হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে হয়েছেন কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কোম্পানির ওয়েবসাইট, আইডিআরএ এবং রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি)-এ দেয়া নতুন বীমা কোম্পানিগুলোর পরিচালক-সংক্রান্ত তথ্যেও অনেক গরমিল দেখা গেছে।
আরজেএসসি’র তথ্য অনুয়ায়ী, সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক নারগিস মাহমুদার শেয়ার সংখ্যা ১০ লাখ। তবে নিবন্ধনের সময় উদ্যোক্তা-পরিচালক হিসেবে থাকলেও এখন তিনি কেবল শেয়ারহোল্ডার। একইভাবে আরেক উদ্যোক্তা পরিচালক ফৌজিয়া খানও সোনালী লাইফে শেয়ারহোল্ডার হিসেবে রয়েছেন। সোনালী লাইফের উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবে তার ৩ লাখ ৩০ হাজার শেয়ার ছিল। এ ছাড়া কোম্পানির ওয়েবসাইটে এখন এবিএম আবদুল লতিফ নামে এক ব্যক্তির নাম উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবে দেখা গেলেও আরজেএসসি-তে এর কোনো রেকর্ড নেই।
বীমা খাতের আরেক নতুন কোম্পানি বেস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক খোরশেদ আলমের শেয়ার সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৪০ হাজার। তবে তিনি তার হাতে থাকা শেয়ারগুলো ছেড়ে দিয়ে কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বলে জানান কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক একরামুল আমিন। বীমা খাতের আরেক প্রতিষ্ঠান প্রটেকটিভ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক হিসেবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলামকে দেখানো হলেও তিনি নিজেও তা জানেন না।
এছাড়া স্বাক্ষর জাল করে পরিচালক হিসেবে ব্যবসায়ীর নাম অন্তর্ভূক্তির অভিযোগ উঠেছিল প্রটেকটিভ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে। এ অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মোরশেদ আরিফ চৌধুরী। এ ব্যাপারে প্রটেকটিভ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের কাছে চিঠিও দিয়েছিলেন তিনি।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন/এসএ/খান