নাজমুল ইসলাম ফারুক : দুই বিশাল ক্ষত বহন করে চলেছে দেশের পুঁজিবাজার। একটি ১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারি এবং অন্যটি ২০১০ সালের ধস। এই দুই ক্ষতের রেশ এখনো কাটেনি। ১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত চুনোপুটি কিছু ধরা পড়লেও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে রাঘববোয়ালরা। একইভাবে ২০১০ সালের ধসের সঙ্গে জড়িতদের বিচার হয়নি, তবে বাজারের কিছু সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপেও বাজারে স্থিতিশীলতা স্থায়ী হচ্ছে না, আস্থা ফেরেনি বিনিয়োগকারীদের।
প্রথমবার দেশের পুঁজিবাজারে বড় ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ১৯৯৬ সালে। ওই বছর জুলাই থেকে বাজারে সূচক বাড়তে শুরু করে। ৫ নভেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক দাঁড়িয়েছিল ৩ হাজার ৬৪৮ পয়েন্টে। এরপর থেকে সূচক কমতে শুরু করে। ১৯৯৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর সূচক কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৩০০ পয়েন্টে। দুই মাসের ব্যবধানে ১ হাজার ৩৪৮ পয়েন্ট পতন হয় সূচকের। ওই সময় লাখ লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তৎকালীন সরকার বাজারের এই লুটতরাজের তদন্ত করতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অর্থনীতিবিদ আমীরুল ইসলামের নের্তৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছিল। কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে; কিন্তু ওই ঘটনার সঙ্গে একাধিক প্রভাবশালী মহল জড়িত থাকায় প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়নি। পরবর্তীতে দীর্ঘ ১৮ বছর পর ২০১৫ সালের ২১ জুন পুঁজিবাজার ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে ওই সময়ে বাজারে লুটতরাজের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু রাঘববোয়ালরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। আদালতের রায়ে কয়েকজন চুনোপুটির সাজা হয়েছে।
এরপর ২০০৯-’১০ সালে বাজারে আরেকটি বিশাল ধসের ঘটনা ঘটে। ওই সময় একদিনে সূচক ৬০০ পয়েন্ট পতন হয়েছে। পুঁজি হারিয়ে বিনিয়োগকারীরা রাজপথে নামেন। এর জের ধরে অনেকে আত্মহত্যাও করেন বলে শোনা যায়। ওই ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দাকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। এই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছিল। এ কমিটির প্রতিবেদনে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার পাশাপাশি বাজার সংস্কারের জন্য কিছু সুপারিশ করা হয়। এ ধারাবাহিকতায় সরকার পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংস্কার করেছে। পরবর্তীতে বাজার সংস্কারে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে কমিশন। পাশাপাশি অনেক আইনের সংস্কারও করেছে কমিশন। কিন্তু ঘটনার জন্য দায়ীদের সাজা দেয়া এখনো সম্ভব হয়নি।
পুঁজিবাজারের দুই ক্ষতের বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও ‘বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন’ (বিএসইসি)-এর সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ‘শেয়ারবাজার প্রতিদিন’-কে বলেন, ‘ওই দুই ঘটনার পর থেকে শেয়ারবাজারের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে বাজারে গতি ফেরাতে সরকার অনেক কাজ করেছে। কিন্তু বাজারে কোনো প্রাণ সঞ্চার ঘটেনি। চলতি বছরের বাজেটে নানা প্রণোদনা দেয়ার পরও বাজার উজ্জীবিত করতে পারেনি। এর মানে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো যাচ্ছে না।’
বাজার ধসের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ‘শেয়ারবাজার প্রতিদিন’-কে বলেন, “২০১০ সালের প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ দিয়েছিলাম, সেগুলোর ধারে-কাছেই যাওয়া হয়নি। আমরা ডি-মিউচ্যুয়ালাইজেশনের কথা বলেছিলাম। ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন সম্পন্ন হয়েছে। ডি-মিউচ্যুয়ালাইজেশন অর্থ হলো স্টক ব্রোকারদের থেকে পরিচালনা পর্ষদকে পৃথক করা, যাতে স্বার্থের সংঘাত না ঘটে। কিন্তু যে ডি-মিচ্যুয়ালাইজেশন হয়েছে তা আদর্শিকভাবে হয়নি, ব্রোকারদের জন্য সেফটি ক্লজ রেখে দেয়া হয়েছে। ডিএসই’র বোর্ডে সদস্যদের মধ্য থেকে পরিচালক থাকবে না বলেছিলাম; কিন্তু সেখানে তাদের একটি অংশ রয়েছে। পরিচালনা পর্ষদে ব্রোকারদের সংখ্যালঘিষ্ঠ-সংখ্যক প্রতিনিধি রয়েছে। শক্তিশালী সংখ্যালঘিষ্ঠরা দুর্বল সংখ্যাগরিষ্ঠকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। অর্থাৎ খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রভাবশালী একটি অংশই জড়িত রয়েছে ডিএসই’র পর্ষদে। ”
এদিকে, বছরের বেশিরভাগ সময় বাজার মন্দা থাকার বিভিন্ন সময় বিষয়ভিত্তিক সংস্কারও করেছে কমিশন। এর মধ্যে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা বা এক্সপোজার লিমিট নিয়েও বাজার মাঝেমধ্যে হঠাৎ পতন হয়েছে। এ কারণে এক্সপোজার লিমিটের বিষয়টি কমিশন ছাড় দিয়েছে। স্টেকহোল্ডাররা মন্দা বাজারকে স্থিতিশীল বাজারে রূপ দিতে যৌথ কমিটি করেও চেষ্টা করে যাচ্ছে। চলতি বাজেটে লভ্যাংশের ওপর দ্বৈত করের বিষয়টি গুরুত্বারোপ করে তা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হলে সরকার তা-ও করেছে। লভ্যাংশের কর সীমা বাড়ানো হয়েছে। তারল্য সংকট কাটাতে সরকার হস্তক্ষেপ করেছে; কিন্তু ২০১০ সালের ধসের পর প্রায় ৯ বছর অতিক্রম হলেও বাজারে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আসছে না।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর প্রসঙ্গে এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হলে ভালো কোম্পানির শেয়ারবাজারে আনতে হবে। বিশেষ করে সরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারবাজারে আনতে হবে। ভালো কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হলে সূচকে প্রভাব পড়বে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে লেনদেনেও। এতে বাজারে গতি ফিরবে।’
একই প্রসঙ্গে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘ডিএসই’র যে সদস্য সংখ্যা রয়েছে তা খুবই সামান্য। এর সদস্য সংখ্যা ১ হাজার হওয়া উচিত। আর এই সদস্য দিতে হবে তরুণ ও নতুন উদ্যোক্তাদের। যতক্ষণ পর্যন্ত সঠিকভাবে এসব কাজ না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বাজার দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতায় আসবে না।”
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষার বিষয়ে ‘বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন’ (বিএসইসি)-এর ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেন ‘শেয়ারবাজার প্রতিদিন’-কে বলেন, ‘কমিশনের কাজ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ, সিকিউরিটিজ মার্কেটের উন্নয়ন এবং আনুষঙ্গিক বিধি প্রণয়ন। আর সেটা করতে গিয়ে আমাদের বিভিন্ন সময়ে আইনের পরিবর্তন ও সংস্কার করতে হয়েছে। আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর দেখেছি, এখানে আইনগত ভিত দুর্বল রয়েছে। সংস্কারের মাধ্যমে আমরা সেই দুর্বলতা কাটানোর চেষ্টা করেছি।’ নানা সংস্কারের মাধ্যমে এখন একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন/এসএ/খান