ইঞ্জিনিয়ার এএমএম সাজ্জাদুর রহমান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড
ইঞ্জিনিয়ার এএমএম সাজ্জাদুর রহমান। ২০১৬ সালের ২২ ফ্রেরুয়ারি থেকে ‘আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে এই দায়িত্ব পালনের আগে তিনি প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌঃ) ও ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। বুয়েট থেকে স্নাতক শেষ হওয়ার পর ১৯৮৩ সালে বিপিডিবি’র টঙ্গী আঞ্চলিক ট্রেনিং সেন্টারে সহকারী প্রকৌশলী (প্রশিক্ষক) হিসাবে সাজ্জাদুর রহমানের কর্মজীবন শুরু হয়। এই দীর্ঘ সময়ের কর্মজীবনে প্রতিটা ক্ষেত্রে তিনি সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। এখনো দক্ষতার সাথে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির বন্ড ইস্যুর বিষয়ে ‘দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন’-এর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : আশুগঞ্জ পাওয়ারের পুঁজিবাজারে আসাকে আপনি কীভাবে দেখছেন।
এএমএম সাজ্জাদুর রহমান : বর্তমানে যেসব সরকারি লাভজনক কোম্পানি পুঁজিবাজারের বাইরে রয়েছে, সরকার চাচ্ছে সেগুলো যেন পুঁজিবাজারে আসে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ‘আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি’ বন্ডের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসছে। আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আমরা সেই টাকার একটা বড় অংশ পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করতে চাই। আমরা প্রথম সরকারি কোম্পানি হিসেবে বন্ডের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসছি। আমরা এই যাত্রায় পাইওনিয়ার হিসেবে কাজ করছি। আমাদের দেখে অন্যান্য সরকারি কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসবে বলে আশা করছি। কারণ এসব সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অনেক বেশি টাকার প্রয়োজন। সারা জীবনই বিদেশি ফান্ডের ওপর নির্ভর করে থাকা ঠিক হবে না। এখন দেশেই পর্যাপ্ত টাকা রয়েছে। পুঁজিবাজারে থেকে অর্থ উত্তোলন করে আমরা বিদেশি ফান্ড নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারি। আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির পুঁজিবাজারে আসাটা আমি ইতিবাচক মনে করি। পাশাপাশি বিশ্বাস করি, এই বাজারে যেসব বিনিয়োগকারী রয়েছেন তারা আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির পুঁজিবাজারে আসাকে খুব আগ্রহের সাথে গ্রহণ করবেন।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : বিদ্যুৎ খাতে আশুগঞ্জ পাওয়ারের অবদান সম্পর্কে যদি বলেন।
এএমএম সাজ্জাদুর রহমান : বর্তমানে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। সেই হিসাবে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কোম্পানিটি। বর্তমানে সারা দেশে বিদ্যুতের মাধ্যমে মানুষ যে সুবিধা ভোগ করছে, তাতে বড় অবদান রাখছে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : বন্ডের মাধ্যমে কেন পুঁজিবাজারে আসছেন? মূল মার্কেটে কেন আসছেন না।
এএমএম সাজ্জাদুর রহমান : দেখুন আমরা একটি সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি। সরকারি কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করাই কোম্পানির মূল লক্ষ্য। আমরা প্রথম ধাপে বন্ডের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের জন্য নির্দেশনা পেয়েছি। সেই নির্দেশনা মোতাবেক আমরা কাজ করছি। পরবর্তীতে সরকার যদি পুঁজিবাজারের মূল মার্কেটে তালিকাভুক্ত হওয়ার নির্দেশনা দেয়, তবে সেই মোতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ইক্যুইটি শেয়ারের বিপরীতে আশুগঞ্জ পাওয়ারের বন্ড কেন কিনবেন?
এএমএম সাজ্জাদুর রহমান : প্রথমত, আমি আবারো বলবো আমরা একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। আপনি আমাদের অ্যাকাউন্টস দেখেন, আমরা ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করেছি। বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতার পাশাপাশি আমাদের লাভের পরিমাণ প্রতি বছর বেড়েছে। সামনে আরো নতুন নতুন প্রকল্প রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হলে মুনাফা আরো বাড়বে। দ্বিতীয়ত, এটা একটি নিরাপদ বন্ড। এখানে বিনিয়োগ করে পুঁজি হারানোর ভয় নেই। বিনিয়োগ বিনিময়ে নির্ধারিত মুনাফা পাবেন বিনিয়োগকারীরা। এই বিনিয়োগের অর্থ ৭ বছরের মধ্যে মুনাফাসহ ফিরে পাবেন। ইক্যুইটি শেয়ারের মতো এখানে মূলধন কমে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া একজন সাধারণ বিনিয়োগকারী এই বন্ড মার্কেটে ইক্যুইটি শেয়ারের মতো লেনদেন করতে পারবেন। তবে যারা এ বন্ড কিনে বিনিয়োগ করবেন, তারা নির্ধারিত হারে সুদ হিসেবে মুনাফা পাবেন। এই হার নির্ধারণ করা হবে ১৮২ দিন মেয়াদী ট্রেজারি বিলের সুদের হারের সাথে ৪% মার্জিনযুক্ত হার (যা সর্বনিম্ন সাড়ে ৮ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ সাড়ে ১০ শতাংশ)। বন্ডটির কুপন অর্ধবার্ষিক থেকে প্রদেয় হবে। স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে ইস্যুয়ারের ব্যাংক হিসাবে তহবিল স্থানান্তরের দিন থেকে ১২ মাস পর প্রথম কুপন প্রদান করা হবে। বন্ডটি ৪ কিস্তিতে সম্পূর্ণভাবে অবসায়ন হবে। এর মধ্যে প্রথম ৩ বছর পর চতুর্থ বছরে ২৫ শতাংশ, পঞ্চম বছরে ২৫ শতাংশ, ষষ্ঠ বছরে ২৫ শতাংশ এবং সপ্তম বছরে ২৫ শতাংশ অবসায়ন হবে।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : আশুগঞ্জ পাওয়ারের ব্যবসায়িক ভবিষ্যৎ নিয়ে বলেন।
এএমএম সাজ্জাদুর রহমান : বিদ্যুৎ বিভাগের মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আমাদের আরো একটি ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে। আগামী বছরের ডিসেম্বরে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হবে। এছাড়া আমাদের পটুয়াখালিতে কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট করার পরিকল্পনা রয়েছে। আরো ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের মহাপরিকল্পনার সাথে মিল রেখে আমাদের মহাপরিকল্পনা রয়েছে, সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
শেয়ারবাজার প্রতিদিন : বন্ডের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসার চ্যালেঞ্জ কি মনে করছেন।
এএমএম সাজ্জাদুর রহমান : এটা আমাদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। এই প্রক্রিয়ার সাথে আগে আমাদের পরিচয় ছিল না। আমরা এ বন্ড ইস্যু করতে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। তবে এটা নতুন হওয়াতে মানুষকে বুঝানোটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীকে বোঝাতে সময় লাগছে। এরপরও আমরা আশা করছি বিনিয়োগকারীরা বুঝবেন বন্ডে বিনিয়োগ বিষয়ে এবং আমরা প্রত্যাশিত সাড়া পাবো।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : আশুগঞ্জ পাওয়ারের বিষয়ে আপনার কোনো ম্যাসেজ আছে কি?
এএমএম সাজ্জাদুর রহমান : আপনারা আমাদের ওয়েবসাইট দেখেন, বার্ষিক প্রতিবেদন দেখেন। আমাদের ইতিহাস দেখেন। আশুগঞ্জ একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান সেই ‘বিপিডিবি’ আমল থেকে। তাই বিনিয়োগকারীদের বলবো আপনারা নিশ্চিন্তে এই বন্ডে বিনিয়োগ করুন। কারণ আমরা যদি সফল হই তবে অন্যান্য সরকারি কোম্পানি এই বাজারে আসবে। ইতোমধ্যে অনেক কোম্পানি আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছে।তাই আমি বিনিয়োগকারীদের বলবো আপনারা আশুগঞ্জ পাওয়ারের বন্ডে নিরাপদ বিনিয়োগ করুন।
এদিকে আশুগঞ্জ পাওয়ারের পুঁজিবাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে বন্ড ইস্যু করে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলনের চাঁদা গ্রহণ চলছে। উত্তোলিত অর্থের মধ্যে ভূমি উন্নয়ন এবং সিভিল কাজের জন্য ব্যয় করা হবে ৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। প্রাইমারি জ্বালানির জন্য ৩০ কোটি টাকা, যানবাহন কেনা বাবদ খরচ করা হবে ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনসালটেন্সি সেবা বাবদ খরচ করা হবে ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ওয়ার্কিং ক্যাপিটালে ১০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা এবং আইপিও বাবদ খরচ করা হবে ৪ কোটি ২১ লাখ টাকা।
অন্যদিকে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন প্রতিটি ৫ হাজার টাকার ইস্যু মূল্যের ২ লাখ নন-কনভার্টেবল, পুরোপুরি অবসায়নযোগ্য, কূপন বিয়ারিং বন্ড আইপিওর মাধ্যমে ইস্যু করবে। এর মধ্যে মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও সিআইএসের ১০ শতাংশসহ মোট ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ১ লাখ বন্ড প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বাকি ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ১ লাখ বন্ড এনআরবিসহ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি ২০০০ সালে একটি সরকারী মালিকানাধীন প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে কোম্পানিটি পাবলিক লিমিটেডে রূপান্তর হয়। কোম্পানিটির মূল ব্যবসা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বিউবো’র মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বিক্রি করা। কোম্পানিটি ৩০ জুন ২০১৭ সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানির নিট সম্পদ মূল্য (এনএভি) ২৬৫ টাকা ৯৬ পয়সা। আর শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ২২ টাকা ৭৮ পয়সা। বিগত ৫ বছরের ওয়েটেড এভারেজ শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ১০ টাকা ৬৩ পয়সা। ১০০ টাকা অভিহিত মূল্যের কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা ১৫০ কোটি ৭২ লাখ টাকা। আর পরিশোধিত মূলধন ৬৬১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। মোট শেয়ার সংখ্যা ৬ কোটি ৬১ লাখ ৫০ হাজার। উল্লেখ্য, কোম্পানিটির ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট এবং ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট কাজ করছে। এছাড়া ট্রাস্টি হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন/এসএ/খান