বাতিল হচ্ছে গাড়ির থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স, আয় বাড়বে বীমা কোম্পানির

সময়: বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৩, ২০১৯ ১০:২০:৪২ পূর্বাহ্ণ


অনুপ সর্বজ্ঞ: ট্রাফিক আইন অনুযায়ী যেকোনো যান্ত্রিক যানবাহন রাস্তায় নামাতে হলে তার বীমা বাধ্যতামূলক। আর তা না হলে ঠুকে দেয়া হয় মামলা। এই মামলা থেকে বাঁচতে ফার্স্ট পার্টি ও থার্ড পার্টি দুই ধরনের ইন্স্যুরেন্সেরই প্রচলন রয়েছে। ফার্স্ট পার্টি ইন্স্যুরেন্সে বীমাকৃত গাড়িতে সংঘটিত দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত ব্যক্তি এবং ক্ষতিগ্রস্ত যানের মালিক দুই পক্ষেরই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিধান রয়েছে। আর স্বল্প প্রিমিয়ামে থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্সে ক্ষতিপূরণ পাবেন শুধু গড়িতে সংঘটিত দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত ব্যক্তি। স্বল্প প্রিমিয়াম ও নিয়ম রক্ষার কারণে এ দেশে থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্সের প্রচলনই বেশি। অথচ এ বীমার বিপরীতে দুর্ঘটনায় কবলিত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কোনো নজির নেই। এ অবস্থায় থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স বাতিলের নির্দেশনা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল।
এ প্রসঙ্গে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সদস্য গকুল চাঁদ দাস বলেন, ‘অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স বাতিলের একটি নির্দেশনা এসেছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা শিগগিরই যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসবো।’
বীমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স বাতিল করা হলে গ্রাহকরা ফার্স্ট পার্টি ইন্স্যুরেন্স করতে বাধ্য হবে। এতে দুর্ঘটনায় কবলিত যানের মালিক ও গাড়িতে সংঘটিত দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত ব্যক্তি যেমন উপকৃত হবে, তেমনি আয় বাড়বে বীমা কোম্পানির। আর বীমা কোম্পানির আয় বাড়লে সরকারেরও রাজস্ব বাড়বে এ খাত থেকে । কারণ থার্ড পার্টির তুলনায় ফার্স্ট পার্টি ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম অনেক বেশি।

জানা যায়, প্রাইভেট মোটর বাইকের থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্সে সর্বোচ্চ প্রিমিয়াম ২৫৯ টাকা। অন্যদিকে ফার্স্ট পার্টি ইন্স্যুরেন্সে এর প্রিমিয়াম সর্বনিম্ন ৪ হাজার ৭৮২ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৯০২ টাকা।
প্রাইভেট কারের ক্ষেত্রে থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্সে সর্বনিম্ন প্রিমিয়াম ৪১৪ টাকা ও সর্বোচ্চ ৭৫৯ টাকা। অন্যদিকে ফার্স্ট পার্টি ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম সর্বনিম্ন ৬৪ হাজার ৭৮৩ টাকা ও সর্বোচ্চ ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৩৮ টাকা।
থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্সে ট্রাকের সর্বনিম্ন প্রিমিয়াম ৭৮২ টাকা ও সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৭৬১ টাকা। ফার্স্ট পার্টি ইন্স্যুরেন্সের সর্বোচ্চ প্রিমিয়াম ৯৯ হাজার ৩৫৮ টাকা।
বাসের ক্ষেত্রে থার্ড পার্টিতে সর্বনিম্ন প্রিমিয়াম ১ হাজার ৯০৯ টাকা ও সর্বোচ্চ প্রিমিয়াম ২ হাজার ২৭৭ টাকা। এদিকে ফার্স্ট পার্টিতে বাসের সর্বোচ্চ প্রিমিয়াম ৪ লাখ ৬৭ হাজার ২২৭ টাকা।

জানা যায়, ফার্স্ট পার্টি ইন্সুরেন্স বা কম্প্রিহেনসিভ বীমা পলিসিতে যানবাহনের যন্ত্রাংশের খুটিনাটি ত্রুটি পর্যালোচনা করা হলেও থার্ড পার্টি ইন্সুরেন্সে এসবের কোনো বালাই নেই। এমনকি সংশিষ্ট যানের ফিটনেস আছে কি না, তা-ও বীমা কোম্পানিগুলো কোনোভাবে বিবেচনায় নেয় না। কেননা, এ ধরনের বীমায় ক্ষতিপূরণ পরিশোধের যেমন কোনো নজির নেই; তেমনি ক্ষতিপূরণ দাবির হারও অনেকটা শূন্যের কোটায়।

এর কারণ হিসেবে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, বীমা কোম্পানির কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেও অধিকাংশ সময় তা পাওয়া যায় না। এ কারণেই ক্ষতিগ্রস্তরা সাধারণত ‘ক্লেইম’ করেন না। তা ছাড়া একটা ক্লেইম প্রমাণ করতে থানা-পুলিশ থেকে শুরু করে যেসব তথ্যের যোগান দিতে হয়, এতে ২৫-৩০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে যায়। এ কারণে কেউ এসব ঝামেলার মধ্যে যেতে চায় না। অনেকে বিষয়টি জানেও না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যখন মোটর ভেহিকেল অ্যাক্ট তৈরি করা হয় তখন ২০ হাজার টাকার মূল্য ছিল অনেক। কিন্তু বর্তমান সময়ে ২০ হাজার টাকা দিয়ে সাধারণ আহতের চিকিৎসাও হয় না। অথচ উন্নত দেশগুলোতে দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারকে ৭০-৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। যদিও নামমাত্র প্রিমিয়ামে থার্ড পার্টি পলিসি করে এই বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণ পাওয়াও সম্ভব নয় বলে স্বীকার করেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে বেশকিছু বীমা কোম্পানিও এখন থার্ড পার্টি ইন্সুরেন্স উঠিয়ে নেয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। গ্রীনডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির এ চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘থার্ড পার্টি ইন্সুরেন্স হলো রাস্তায় গাড়ি নামানোর জন্য একটি আইনি স্বীকৃতি। এখানে কোনো দাবি পূরণ হয় না। ফলে এ ধরনের বীমার কোনো ভিত্তি নেই। বিশ্বের অনেক দেশে এই ধরনের বীমা নেই। কারণ যারা সচেতন, তারাই এটি উঠিয়ে নিচ্ছেন। আর আমরা নিজেরাও এটি উঠিয়ে নেয়ার পক্ষে।’

প্রসঙ্গত, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে যানবাহনের থার্ড পার্টি ইন্সুরেন্স চালু থাকলেও এ পলিসি করার সময় সংশ্লিষ্ট যানবাহনের ফিটনেস থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে যান্ত্রিক ত্রুটিসহ মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স করতে পারছে না। যার ফলশ্রুতিতে সেখানকার সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এছাড়া ভারতের বীমা কোম্পানিগুলো সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করছে বলে জানা গেছে।
এদিকে আইনি দুর্বলতার সুযোগে প্রতিবছর বীমা কোম্পানিগুলো থার্ড পার্টি ইন্সুরেন্স বাবদ কী পরিমাণ অর্থ আয় করছে এবং দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের তারা ক্ষতি পূরণের কত টাকা থেকে বঞ্চিত করছে এর কোনো হিসাব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দিতে পারেনি। তবে মোটা দাগে এর পরিমাণ যে একেবারে কম নয়Ñ এরকম হিসাব পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে দেশজুড়ে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছে মোট ৭ হাজার ২২১ জন। আহত হয়েছে ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৭ হাজার ৩৯৭ জন। আর আহতের সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ১৯৩ জন।

থার্ড পার্টি বীমার সুবিধা অনুসারে ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৭ হাজার ২২১ জনের পরিবার সর্বমোট ১৪ কোটি ৪৪ লাখ ২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। দুর্ঘটনায় প্রত্যেক আহতের বিপরীতে ৫ হাজার টাকা হিসাবে ৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, আর ১০ হাজার টাকা হিসেবে ১৫ কোটি ৪৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। অথচ তারা কেউ বীমা বাবদ কোনো টাকা পাননি।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন/এসএ/খান

Share
নিউজটি ৮৭৪ বার পড়া হয়েছে ।
Tagged