ডেল্টা লাইফ থেকে প্রশাসক তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত

সময়: রবিবার, জানুয়ারি ৯, ২০২২ ১২:৫০:৩৪ অপরাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক: শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আলোচিত কোম্পানি ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স থেকে প্রশাসক তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। আর সরকার ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) যৌথভাবে কোম্পানিটির জন্য নতুন একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠন করবে।এদিকে, ডেল্টা লাইফ কর্তৃপক্ষ আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করবে। আর ডেল্টা লাইফের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলোও প্রত্যাহার করবে আইডিআরএ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উদ্যোগে বুধবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম, আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেন, ডেল্টা লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান (বর্তমানে পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান) মঞ্জুরুর রহমান, তাঁর ছেলে ডেল্টা লাইফের সাবেক পরিচালক জেয়াদ রহমান এবং সংশ্লিষ্টরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে, বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট ডেল্টা লাইফে আইডিআরএ কর্তৃক প্রশাসক নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে এবং কোম্পানিটির আগের পর্ষদকে বহাল করেছে। কোম্পানিটির আগের পর্ষদের এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এই রায় ঘোষণা দিয়েছে।

তবে হাইকোর্টের রায় আগের পর্ষদের অনুকূলে থাকলেও মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করা হবে। কারণ সরকার আগের পর্ষদের পরিচালকদের নিয়ে কোম্পানিটির জন্য নতুন পর্ষদ গঠন করতে চায়। এমন বার্তা কোম্পানিটির আগের পর্ষদের কাছে পৌঁছায় তারা এই নিয়ে আর বাক-বিতন্ডায় যেতে চায় না।

অন্যদিকে, কোম্পানিটিতে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত তথ্যপ্রযুক্তি খাতের এবং চামড়া খাতের দুই প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালী দুই কর্ণধার কোম্পানিটির পরিচালক হতে চান। এই লক্ষ্যে তারা কোম্পানিটির শেয়ার কেনাও শুরু করেছেন।

অপরদিকে, ক্রিকেটের এক সেরা ক্রিকেটার এবং শেয়ারবাজারের এক বড় শেয়ার ব্যবসায়ীও কোম্পানিটিতে তাদের প্রতিনিধি পরিচালক করা জন্য জোর লবিং করছেন। তারাও বাজার থেকে কোম্পানিটির শেয়ার কিনছেন। এছাড়া, পোশাক খাতের এক বড় শিল্প উদ্যোক্তা অনেক আগে থেকেই কোম্পানিটির পরিচালক হওয়ার দৌড়ে সামিল হয়েছেন।
ফলে অঢেল সম্পদের ও বিপুল লাইফ ফান্ডের প্রতিষ্ঠান ডেল্টা লাইফ কোম্পানির পরিচালক পদ এখন সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। কোম্পানিটির জীবন তহবিল রয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এছাড়া, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে প্রায় আরও ২ হাজার কোটি টাকা। কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রায় আড়াই হাজার।

যদিও কোম্পানিটির বিনিয়োগকারীরা গত তিন বছর যাবত কোন ডিভিডেন্ড পাচ্ছেন না। সর্বশেষ ২০১৮ সালে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড দিয়েছিল। নতুন পর্ষদ গঠিত হলে বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড পাওয়ার পথটি সুগম হবে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক বছরের বেশি সময় ধরে শেয়ারবাজারের আলোচিত কোম্পানি ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্সে নিয়মিত পরিচালনা পর্ষদ নেই। বিমা খাতের শীর্ষ স্থানীয় এই প্রতিষ্ঠানটি ১১ মাস ধরে চলছে প্রশাসকের নেতৃত্বে। এখন পর্যন্ত চার মাস করে তিনজন প্রশাসক দায়িত্ব পালন করেছেন। একের পর এক প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছে আইডিআরএ।

এর আগে কোম্পানিটিতে প্রথম প্রশাসক বসানো হয় গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি। আইডিআরের সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লাকে প্রথম প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। এর চার মাস পর দ্বিতীয় প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয় সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব মো. রফিকুল ইসলামকে। গত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে তৃতীয় প্রশাসক নিয়োগ পেয়েছেন বিমা খাতের বাইরের ব্যক্তি আইডিআরের আরেক সাবেক সদস্য (প্রশাসন) মো. কুদ্দুস খান।

আইডিআরএ ও ডেল্টা লাইফ সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানিটির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ৩৪টি মামলা করা হয়েছে আইডিআরএ ও এর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। বর্তমানে মামলা আছে ২১টি। আর আইডিআরএর পক্ষ থেকে ডেল্টা লাইফের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে চারটি। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, মোট ২৫ মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেবে দুই পক্ষই।

বৈঠক সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রশাসক দিয়েও আর কোম্পানিটিকে পরিচালনা করা হবে না। সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বিএসইসি যৌথভাবে একটি পরিচালনা পর্ষদ ঠিক করবে। ওই পর্ষদের পরিচালনায় ও নতুন ব্যবস্থাপনায় কোম্পানি চলবে। তবে ডেল্টা লাইফের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আদিবা রহমান নতুন করে কোম্পানিটিতে সিইও হিসেবে থাকতে পারবেন না। নতুন পর্ষদ গঠনের ক্ষেত্রে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক এবং কোম্পানিটির ৫ শতাংশের বেশি শেয়ার রয়েছে, এমন বিনিয়োগকারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

জানা যায়, কোম্পানিটিতে এক সময়ে এমনও ছিল যে বাবা মঞ্জুরুর রহমান চেয়ারম্যান ও মেয়ে আদিবা রহমান সিইও ছিলেন। আর্থিক খাতের কোনো কোম্পানিতে এমন ঘটনা বিরল। ২০১৮ সালের অক্টোবরে হঠাৎ এই কোম্পানিতে স্বতন্ত্র পরিচালকের পাশাপাশি চেয়ারম্যান হিসেবেও নিয়োগ পান সাবেক সেনাপ্রধান এবং সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রী লে. জেনারেল (অব.) এম নূর উদ্দিন খান। সিইও হিসেবে আদিবা রহমান তখনো থেকে যান।

সূত্রগুলো জানায়, একই পদে নিয়োগ পেতে আইডিআরএর কাছে আদিবা রহমান আবেদন করেছিলেন ২০২০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। কিন্তু একই বছরের ১৬ নভেম্বর আইডিআরএ তাঁর আবেদন নামঞ্জুর করে। রাজস্ব ফাঁকি ও আর্থিক অনিয়ম, বিমা পলিসি গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডারের লিখিত অভিযোগ, সিইও হওয়ার জন্য অসত্য তথ্য উল্লেখসহ নানা অভিযোগে আদিবা রহমানের আবেদন নামঞ্জুর করে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর ডেল্টা লাইফের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ৫০ লাখ টাকা উৎকোচ চাওয়ার অভিযোগ করা হয়। এক সপ্তাহ পর দুদকে আরেক আবেদনে বলা হয়, অভিযোগটি অসত্য। সর্বশেষ গত মাসে ডেল্টা লাইফের স্থগিত পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ৭৪ পৃষ্ঠার চিঠি দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতি, রাজস্ব ফাঁকি ও অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা ক্ষতিসাধনের অভিযোগ আনে আইডিআরএ।

দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন/এসএ/খান

Share
নিউজটি ২৪১ বার পড়া হয়েছে ।
Tagged