নিজস্ব প্রতিবেদক: শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটা লিমিটেডের বিরুদ্ধে ২২৭ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেছেন কোম্পানিটি সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাহতাব উদ্দিন আহমেদ।
অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করে অবসর-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগে ঢাকার যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সোমবার তিনি মামলাটি দায়ের করেছেন তিনি।
মামলায় রবি আজিয়াটা লিমিটেড ছাড়াও গ্রুপের সাবেক সিইও ইজাদ্দিন ইদ্রিস, রবির বর্তমান বোর্ড চেয়ারম্যান থায়াপরান এস সাঙ্গারা পিল্লাই এবং আরও দুজনকে বিবাদী করা হয়েছে।
বাদী মাহতাব উদ্দিন আহমেদের আইনজীবী হাসান এম এস আজিম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, মাহতাব উদ্দিন ২০২১ সালের ২ আগস্ট পদত্যাগপত্র জমা দেন, যা ওই বছরের ৩১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। রবির পরিচালনা পর্ষদ ৫ আগস্ট ‘নিঃশর্তভাবে’ সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণের কথা চিঠি দিয়ে জানায়।
কিন্তু ২০২২ সালের ২২ মে রবি আজিয়াটা গ্রুপ মাহতাব উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করার নোটিশ দিয়ে ভূতাপেক্ষে তা কার্যকর করার কথা জানায়।
মামলার আরজিতে ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করতে মাহতাব উদ্দিনকে তার প্রাপ্য অবসর-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার জন্য রবি ওই পদক্ষেপ নেয় অভিযোগ করে প্রাপ্য অবসর সুবিধা ও ক্ষতিপূরণ বাবদ ২২৭ কোটি ২ লাখ ৪৪ হাজার ৫০২ টাকা দাবি করা হয়েছে মামলায়।
মাহতাব উদ্দিন ২০১০ সালে রবির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) পদে যোগ দিয়ে ২০১৬ সালে সিইও হন। পরের পাঁচ বছর তিনি ওই দায়িত্বে ছিলেন।
মামলার আরজিতে বলা হয়েছে, ইজাদ্দিন ইদ্রিস আজিয়াটা গ্রুপের সিইও এবং পরে জিসিইও হওয়ার পর থেকেই মাহতাবকে ‘চ্যালেঞ্জের’ মুখে পড়তে হচ্ছিল। প্রাথমিকভাবে এর কারণ ছিল মাহতাবের দীর্ঘ দিনের ‘বকেয়া বেতন নিয়ে বিরোধ’। পরে অন্যান্য ঘটনায় সেই বিরোধ আরও জটিল হয়।
এই প্রেক্ষাপটে জিসিইও ইজাদ্দিন ইদ্রিস একাধিকবার লিখিতভাবে মাহতাবকে ‘হুমকি’ দিয়েছিলেন বলেও আইনজীবীর ভাষ্য।
মামলার আরজিতে আরও বলা হয়, মাহতাব পদত্যাগ করার পর ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর রবি হঠাৎ করে ২০১৯ সালের একটি আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তাকে ‘কারণ দর্শাও’ নোটিশ পাঠায়, যদিও ওই লেনদেনের বিষয়ে আজিয়াটা গ্রুপ ও রবির বোর্ড ‘অবগত’ ছিল। এরপর ওই বিষয়ে বিভাগীয় তদন্ত শুরু করে রবি।
মাহতাব আহমেদের মামলায় বলা হয়েছে, অনিয়মের ওই অভিযোগ ছিল ‘সম্পূর্ণ অসত্য’। ২০২১ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণীতেও ওই আর্থিক লেনদেন নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রবির ৬১ দশমিক ৮২ শতাংশ মালিকানা রয়েছে মালয়েশিয়ার বহুজাতিক কোম্পানি আজিয়াটার হাতে। এ ছাড়া ভারতের এয়ারটেল ২৮ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাকি ১০ শতাংশ শেয়ারের মালিক।
তিন বছর চুপ ছিলাম। আর নয়: মাহতাব উদ্দিন
মাহতাব উদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার রাতে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে সার্বিক বিষয় নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
তাতে তিনি লিখেছেন, ‘আমি প্রায় তিন বছর চুপ ছিলাম। আজ আর নয়। বন্ধ দরজার আড়ালে যা যা হয়েছে সবকিছুই আমার রবি টিম, পরিবার এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা জানার অধিকার রাখেন।’
‘২০১৯ এর আগস্ট থেকে এ্যাক্সিয়াটা গ্রুপ এবং গ্রুপের জিসিইও (দাতো’ ইজ্জাদিন ইদ্রিস) এর সাথে আমার সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করে। কারণ, আমার চুক্তি নবায়ন এবং ভাতা বৃদ্ধি বিষয়ে তাদের গুরুতর অবহেলা। আমি যথেষ্ঠ সম্মানের সাথে জিসিইও-এর চুক্তি ফিরিয়ে দেই। নভেম্বর ২০২০ এর এক আলোচনার পরে কোনোরকমের মনোমালিন্য ছাড়াই আমি সেখান থেকে সরে আসতে চাই, যার প্রত্যুত্তরে আমি সম্ভাব্য ফলাফলের হুমকি সহ ইমেইল পাই। সত্যি বলতে, তাদের দেয়া মিথ্যা আশ্বাস এবং সংশোধিত বেতন-ভাতা আমার চাকরী, আমার স্বপ্ন, আমার সবকিছুকেই এক অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিয়েছিল। এবং এই সবকিছুই আমার কাজের চুক্তি লঙ্ঘন করেছিল।’
‘এতকিছুর পরও আমি কখনোই আমার কঠোর পরিশ্রম এবং রবি’র প্রতি আমার অঙ্গীকারে ব্যাঘাত ঘটতে দেইনি। ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি এই কোম্পানির প্রতি দায়িত্ব পালন করে গেছি। যখন আমি রবি ছেড়ে দেই, ২০২১ এর আগস্টে, তখন আমার ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার এবং রবি’র পারফর্মেন্স – দুটোই সফলতার শিখরে ছিল। আমার সময়ে কোম্পানিটা উপরের কিছু মানুষের ক্ষমতার দুর্ব্যবহারে নিমজ্জিত ছিল। আমার পদত্যাগের প্রায় ১০ মাস পরে, ২৫ মে ২০২২-এ, আমাকে জানানো হয় যে- আমি অবসর সুবিধাসমূহ পাবো না, কারণ আমাকে ২০২১ এর ৩১ অক্টোবরই বহিষ্কার করা হয়েছে। একটা প্রসিদ্ধ কোম্পানি কি কখনও একজনকে বহিষ্কার করতে পারে, যে তার কোম্পানিতে আর কর্মী হিসেবেই নেই? তাও আবার পদত্যাগের ১০ মাস পরে?’
ফেসবুকে তিনি লিখেন, ‘জিসিইও সাহেব কিন্তু আমার পদত্যাগের পরও হয়রানি থামাননি। আমাকে বিভিন্নভাবে ফাঁসাতে চেয়েছেন, কিন্তু পারেননি। ২০১৯ এর এক ট্রানজেকশন নিয়েও কথা তুলেছেন; আইটেম এর ক্যাপেক্স/ওপেক্স হওয়া নিয়ে। বিক্রেতা থেকে শুরু করে সংবিধিবদ্ধ নিরীক্ষক এবং স্থানীয় ম্যানেজমেন্ট টিম কেউই কোনো অনৈতিক ঘটনা ঘটার ইঙ্গিত দেননি, যেটা রবি’র ২০২১-এর ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টেও প্রতিফলিত হয়।’
মাহতাব আহমেদ লিখেছেন, ‘নিতান্তই কর্পোরেট প্রতিহিংসার কারণে ৩১ বছরের এক্সিকিউটিভ ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করে দেখুন- চুক্তিবদ্ধ বোনাস, শেয়ার, অবসর সুবিধাসমূহ সবকিছু থেকেই আপনি বঞ্চিত হলেন; মর্যাদাহানি আর গুজবের কারণে কর্পোরেট জগতে কুখ্যাত হয়ে উঠলেন। একটি হাই প্রোফাইল ক্যারিয়ার এবং কয়েক দশকের অভিজ্ঞতার জায়গায় চলে আসে আর্থিক বঞ্চনা এবং মানসিক যন্ত্রনা। টাকা দিয়ে এই অবিচারের ক্ষতিপূরণ হবে না।
তিনি বলেন, ‘যারাই আমাকে একজন ব্যাক্তি হিসেবে চেনেন, তাদের বুঝতে একটু কষ্ট হবে যে কেন আমি আদালত থেকে বিচার পাওয়ার এই কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একটি বিলিয়ন ডলার কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করার কথা আমাকে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী থেকে শুরু করে পরামর্শদাতা সবাই বলেছেন। আমি যেন এগুলো ভুলে গিয়ে জীবনে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবি – এই পরামর্শ দিয়েছেন। আমি কীভাবে পারবো সেটা? আমার মতো আরও অনেক বাংলাদেশি এরকম কর্পোরেট পলিটিক্স এবং ফাউল প্লে এর শিকার। এবং বেশিরভাগই ফাইট করার সাহস পাননি, সেই একই ভয়ের কারণে, কিংবা ক্যারিয়ারের ক্ষতি হবার ভয়ে। আজকে, আমি জানি আমি আমার নৈতিক দায়িত্ব পালন করছি। আমি তাদের বিরুদ্ধে ফাইট করছি যারা এ রকমের অনৈতিক কাজ করতে পারে কোনোরকমের পরিণতির ভয় ছাড়াই, কারণ তাদের ক্ষমতা তাদেরকে একজন “ইন্ডিভিজুয়াল” এর চাইতে শক্তিশালী করে রেখেছে। আমার সবার প্রতি একটাই অনুরোধ – রবি এবং আমার প্রতি ন্যায্য অভিমত পোষণ করবেন, এবং মাননীয় আদালত-কে একটি প্রমাণ-ভিত্তিক সিদ্ধান্তে আসার সুযোগ দেবেন।’