পরিশোধিত মূলধনের ভারে ন্যুব্জ ৭ কোম্পানির শেয়ার দর

সময়: বুধবার, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৯ ৯:১৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ


সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : দু’দিন ইতিবাচক থাকার পর গতকাল মঙ্গলবার পুঁজিবাজারে আবার বড় দরপতন হয়েছে। এর আগে ধারাবাহিক পতনের ফলে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার দর তলানীতে নেমেছে। এগুলোর মধ্যে দফায় দফায় বোনাস শেয়ার দিয়ে পরিশোধিত মূলধন বাড়ানো কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর নেমে গেছে অনেক বেশি। এসব কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। কোম্পানিগুলো হচ্ছে- কেয়া কসমেটিকস, ন্যাশনাল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, এবি ব্যাংক, অ্যাপোলো ইস্পাত, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলস লিমিটেড।
কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোম্পানিগুলো বারবার বোনাস শেয়ার প্রদান করার ফলে পরিশোধিত মূলধন এতোটাই বেড়েছে যে, এখন লভ্যাংশ প্রদান করাটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতো বড় পরিশোধিত মূলধন নিয়ে বছরের পর বছর আর নগদ লভ্যাংশ প্রদান করছে না কোম্পানিগুলো। তাতে এতো কম দরের পরও এসব কোম্পানির শেয়ার আর কিনতে চাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, কেয়া কসমেটিকসের বর্তমান শেয়ার সংখ্যা ১০০ কোটি ২১ লাখ ৬ হাজার ৬৬০টি। জেড ক্যাটাগরির কোম্পানিটি ৩০ জুন ২০১৮ সমাপ্ত হিসাব বছরের পর আর কোনো অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। তবে ওই বছর কোম্পানিটি ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে। কোম্পানিটি ২০১১ সাল থেকে লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার প্রদান করছে। কোম্পানিটির সর্বশেষ লেনদেন হয় ৪ টাকা ২০ পয়সায়। বর্তমানে রিজার্ভ রয়েছে ২৮০ কোটি ৭৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
এদিকে ন্যাশনাল ব্যাংক তালিকাভুক্তির প্রথম বছরেই বোনাস শেয়ার প্রদান করে। তবে ২০০৩ সালের পর থেকে টানা বোনাস শেয়ার প্রদান করছে কোম্পানিটি। এতে কোম্পানিটির বর্তমান শেয়ার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬৫ কোটি ৪৯ লাখ ৭ হাজার ৯১৩টি। সর্বশেষ কোম্পানির শেয়ারটি ৭ টাকা ৮০ পয়সা দরে লেনদেন হয়। কোম্পানিটির স্বল্প মেয়াদে ৫২১ কোটি ২৩ লাখ টাকা ঋণ থাকলেও রিজার্ভ রয়েছে ১ হাজার ৩৭৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
আর আইএফআইসি ব্যাংকও তালিকাভুক্তির প্রথম বছরেই বোনাস শেয়ার প্রদান করে। তবে ২০০৩ সালের পর থেকে টানা বোনাস শেয়ার প্রদান করছে কোম্পানিটি। এতে কোম্পানিটির বর্তমান শেয়ার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৩ কোটি ৮৭ লাখ ৩৮ হাজার ৭৩৫টি। সর্বশেষ কোম্পানির শেয়ারটি ৯ টাকা ৬০ পয়সা দরে লেনদেন হয়। কোম্পানিটির স্বল্প মেয়াদে ৮০৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। আর দীর্ঘমেয়াদে ৪৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। তবে কোম্পানিটির রিজার্ভ রয়েছে ৮৭১ কোটি ৬৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
এছাড়া এবি ব্যাংকও ২০০৩ সালের পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত টানা বোনাস শেয়ার প্রদান কর আসছে। এরপর আর লভ্যাংশ প্রদান করতে পারিনি কোম্পানিটি। কোম্পানিটির বর্তমান শেয়ার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৫ কোটি ৮১ লাখ ৩০ হাজার ৩১৬টি। সর্বশেষ কোম্পানির শেয়ারটি ৮ দরে লেনদেন হয়। কোম্পানিটির স্বল্প মেয়াদে ১ হাজার ৯১৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। আর দীর্ঘমেয়াদে ৭৭৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। তবে কোম্পানিটির রিজার্ভ রয়েছে ১ হাজার ৬৩০ কোটি ৪০ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের শেয়ার সংখ্যা ৮২ কোটি ৮০ লাখ ৯৮ হাজার ৪৮০টি। ২০১০ সাল থেকে টানা ৫ বছর লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার প্রদান করে কোম্পানিটি। এরপর আর লভ্যাংশ প্রদান করতে পারিনি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। কোম্পানিটির স্বল্প মেয়াদে ১১৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। আর দীর্ঘমেয়াদে ১৭৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। তবে কোম্পানিটির রিজার্ভ রয়েছে ১০ কোটি ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এদিকে সিএনএ টেক্সটাইলের শেয়ার সংখ্যা ২৩ কোটি ৯৩ লাখ ১৬ হাজার। তালিকাভক্তির পর ৩ বছর বোনাস প্রদান করে কোম্পানিটি। এরপর আর লভ্যাংশ প্রদান করতে পারিনি সিএনএ টেক্সটাইল। এছাড়া অ্যাপোলো ইস্পাত, বিআইএফসির মতো কোম্পানি আর্থিক অবকাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে বোনাসের মাধ্যমে পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর জন্য।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে তারল্য সংকট, আস্থাহীনতা, বাজার রেগুলেটরদের সমন্বয়হীনতা, ব্যবস্থাপনায় অস্বচ্ছতা, ফোর্সড সেল, আর্থিক খাতের নৈরাজ্য, কারসাজির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া, পেনিক সেলসহ নানা ইস্যুতে পুঁজিবাজারে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি দিনের পর দিন লোকসান গুনতে গুনতে কোম্পানিগুলো এ অবস্থায় পতিত হয়েছে। লভ্যাংশ হিসেবে বারবার বোনাস প্রদান করে কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন এতোটাই বৃদ্ধি করা হয়েছে; এখন কোম্পানিগুলো আর লভ্যাংশ দিতে পারছে না।
লাগাতার দরপতনে এমনিতেই দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বিশেষ করে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন তারা। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার এতো কম দরে লেনদেন হওয়াটা আস্থাশীল মার্কেটের বৈশিষ্ট্য নয়। সে জন্য কোম্পানিগুলোর দর তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ- দুর্বল কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। সেসব কোম্পানি কয়েক বছর ভালো মুনাফা দেখিয়ে হঠাৎ করে লোকসানিতে রূপ নিচ্ছে। এরপর চলে যাচ্ছে জেড ক্যাটাগরিতে। ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি শেয়ারবাজারে না আসায় বারবার প্রতারিত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ‘শেয়ারবাজার প্রতিদিন’-কে বলেন, ‘টানা দরপতনে ভালো কোম্পানির শেয়ার দর এমনিতেই কমে যাচ্ছে। সেখানে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার অনেক বেশি কমেছে। ফলে চরম ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদের সঙ্গে। তিনি ‘দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন’-কে বলেন, ‘এসব লোকসানি কোম্পানিগুলো আগেও বিনিয়োগকারীদের ঠেকিয়েছে, এখনও তাই করছে। কোম্পানির ব্যবসা সম্প্রসারণ না করে শুধু বোনাস শেয়ার ইস্যু করেছে। এখন লভ্যাংশ দেয়ার উপায় নেই।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন/এসএ/খান

Share
নিউজটি ৪১৮ বার পড়া হয়েছে ।
Tagged