নিজস্ব প্রতিবেদক : নোবেল করোনা ভাইরাসের কারণে চলতি বছরের রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এবার অনেক পিছিয়ে রয়েছে এনবিআর। তাই আগামী অর্থবছরে এই মহামারির মধ্যেই সরকারের রাজস্ব আরও কিভাবে বাড়ানো যায় সেই বিষয়ে মনোযোগ এনবিআরের। তাই দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে করপোরেট ট্যাক্স কমানোর ঘোষণা আসছে। তবে ঢালাওভাবে সব খাতে নয়, শুধু উৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে জড়িত পুঁজিবাজারে তালিকাবহির্ভূত শিল্পে এ ট্যাক্স কমানো হবে। একই সঙ্গে বিনিয়োগ বাড়াতে বাজেটে নানামুখী পদক্ষেপ থাকবে। যেমন- কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ প্রসারিত করা হবে। আবাসন, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কের পাশাপাশি ট্রেজারি বন্ডে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রগুলো জানায়, আগামী বাজেটে রাজস্ব নীতি প্রণয়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বেগ পোহাতে হচ্ছে। ১৯৭২ সালে এনবিআর গঠনের পর এ ধরনের কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়নি দেশের প্রধান রাজস্ব আদায়কারী এ সংস্থাকে। আগে রাজস্ব নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারের বেঁধে দেওয়া প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রার ওপর ভিত্তি করে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্কহার নির্ধারণ করা হতো। এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। করোনা ভাইরাস সব হিসাবনিকাশ পাল্টে দিয়েছে। ভোগ ও চাহিদা কমে যাওয়ায় বর্তমানে বৈশ্বিক ও দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা একেবারেই নাজুক।
অন্যদিকে দেশে করোনা ভাইরাসের সংকট মোকাবিলায় সরকারকে অর্থের জোগান দিতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা না হলে জোরাজুরি করে রাজস্ব আদায় বাড়ানো যাবে না। এজন্য কর ছাড় দেওয়া প্রয়োজন। আবার কর ছাড় দিলে লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় একেবারেই সম্ভব হবে না, যা ইতিমধ্যেই এনবিআর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। এ কঠিন পরিস্থিতি উত্তরণে রাজস্ব নীতিতে বিনিয়োগকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে করপোরেট ট্যাক্স কমানো হতে পারে। গত ৫ বছর ধরে পুঁজিবাজারে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির ট্যাক্স কমানো হয়নি। পাঁচ বছর আগে বেঁধে দেওয়া সেই ৩৫ শতাংশই বহাল আছে। কিন্তু এর মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও কয়েক দফায় ব্যাংকের করপোরেট ট্যাক্স কমানো হয়। কিন্তু ব্যবসায়ী সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির ট্যাক্স কমানো হয়নি। এবার উৎপাদনশীল খাতের কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্স আড়াই শতাংশ কমানো হতে পারে।
গত ৬ অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে করপোরেট ট্যাক্স আড়াই শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়, যা এখনও বহাল আছে। এরপরের অর্থবছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ট্যাক্স আড়াই শতাংশ কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের ট্যাক্স আড়াই শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪০ শতাংশ ও সিগারেট খাতে ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হয়। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও বহির্ভূত ব্যাংকের করপোরেট ট্যাক্স আরও আড়াই শতাংশ কমিয়ে যথাক্রমে সাড়ে ৩৭ শতাংশ ও ৪০ শতাংশ করা হয়।
এনবিআরের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায় বাড়াতে বিলাসবহুল পণ্য যেমন- গাড়ি, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, সিগারেট, মোবাইল খাতে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হবে। অন্যদিকে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যকে উৎসাহ দিয়ে কর আদায়ে নানা ছাড় দেওয়া হবে। ইতিমধ্যেই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কমাতে এনবিআরের তরফ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের প্রাক্কলিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা যৌক্তিকীকরণের অনুরোধ জানিয়ে অর্থ সচিবকে পাঠানো চিঠিতে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আগামী অর্থবছরের শুরুতে দুর্যোগ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও স্থানীয় ও বৈদেশিক অর্থনীতির ওপর রেখে যাওয়া বিপুল প্রতিক্রিয়ায় আশানুরূপ রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে না। তারপরও বর্তমান বছরের সম্ভাব্য আদায়ের ওপর পূর্ববর্তী গড় প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ হিসাব করা হলে আগামী অর্থবছরের সর্বমোট আহরণ ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে না। অপরদিকে আগামী অর্থবছরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা আদায় দুরূহ হবে।
এর কারণ হিসেবে চিঠিতে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসজনিত দুর্যোগ মহামারি পৃথিবীর সামাজিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। বিশেষত এ দুর্যোগ পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে এবং পূর্বতন জীবনযাত্রা ফিরে আসবে সেটা নির্দিষ্ট করে বলা কারও পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। কর আহরণ ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সারা বিশ্বের সব মানুষের ভোগ, চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। কোভিড-১৯ জনিত পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও সনাতনী ধারায় অর্থনীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আহরণ, বণ্টন, বাণিজ্য ও ভোগে বিপুল পরিবর্তন নিয়ে আসবে এবং সারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশেও পরিবর্তনের ঢেউ আঘাত হানবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্থানীয় ভোগের চাহিদা কমে গেলে আমদানি কমবে, শিল্প-উৎপাদন কমলে কাঁচামাল-যন্ত্রপাতির চাহিদা কমে যাবে। এতে পরোক্ষ করের ওপর ব্যাপক ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে আয়বর্ধক কার্যক্রম কমে গেলে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে প্রত্যক্ষ করও কমে যাবে।
ধারণা করা যায়, নিকট আগামীতে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বড় একটি অংশ জনগণের মৌলিক চাহিদার সেবায় নিয়োজিত হবে। যার মধ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন, খাদ্য, শিক্ষা, আবাসন ও জনগণের নিরাপত্তার দিকেই অধিকতর মনোযোগ নিবিষ্ট করতে হবে। এসব মৌলিক সম্পদ, উৎপাদন, বিপণন, সরবরাহ ও সেবার বেশিরভাগই সম্পূর্ণ করমুক্ত বা ন্যূনতম করের আওতাধীন। তাই নিকট ভবিষ্যতে দুর্যোগ অবস্থা স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও তার দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়ায় রাজস্ব আহরণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান চিঠিতে আরও বলেন, অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলে মাঠপর্যায়ে রাজস্ব আহরণকারী কর্মকর্তাদের ওপর এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি হয়। অনেকে অসম্ভব বিবেচনা করে একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেয় এবং অনেক ক্ষেত্রে করদাতাদের ওপর হয়রানির অভিযোগ আসে। অন্যদিকে লক্ষ্যমাত্রা যৌক্তিক হলে কর্মকর্তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রচেষ্টা থাকে ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কৃতিত্ব পাওয়ার অনুপ্রেরণা তৈরি হয়।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন/এসএ/খান