ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র্য বিমোচনে যথাযথ ভূমিকা রাখছে না

সময়: রবিবার, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯ ১০:১১:৪২ পূর্বাহ্ণ


ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ

চেয়ারম্যান
পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)

ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে না। ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করে না, বরং দারিদ্র্য লালন করে বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনে (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমেদ। তিনি বলেন, এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৭ শতাংশ পরিবার ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য সীমার উপরে উঠে আসতে সমর্থ হয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণ ও শেয়ারবাজারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আমাদের ডেপুটি এডিটর এম এ খালেক-

দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : আপনি বিভিন্ন সময় বলেছেন, ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র্য বিমোচন করে না, দারিদ্র্য লালন করে। কিছুদিন আগে আপনাদের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন। আপনার এ বক্তব্যের প্রেক্ষাপট কি?
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ : ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে আমার বেশ কিছু গবেষণা রয়েছে। সেখানে আমি দেখেছি, ক্ষুদ্র ঋণ প্রকৃতপক্ষে দারিদ্র্য বিমোচনে সেভাবে অবদান রাখতে পারছে না- যেভাবে বলা হয়ে থাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উক্ত অনুষ্ঠানেই বলেছেন, এক সময় তিনি ক্ষুদ্র ঋণকে সহায়তা করেছেন। কিন্তু তিনি দেখেছেন ক্ষুদ্র ঋণ সেভাবে মানুষের উপকারে আসে না। তাই তিনি বলেছেন, ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করে না দারিদ্র্য লালন করে। আমি ২০০৬ সালে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে একটি গবেষণা করেছি। গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয় ২০০৭ সালে। সারা দেশে দৈব চয়নের মাধ্যমে আড়াই হাজার ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা পরিবারের উপর আমি জরিপ করি। ন্যূনতম ৪ বছর ধরে ক্ষুদ্র ঋণ নিচ্ছে আমি তাদেরকেই এ জরিপে অন্তর্ভুক্ত করি। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি এসব পরিবারের মধ্যে মাত্র ৭ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্য সীমার উপরে উঠে আসতে সমর্থ হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল মাইক্রো ক্রেডিট ক্যাম্পেইনের একটি গবেষণা আছে। এ প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ^ব্যাপী ক্ষুদ্র ঋণের প্রচার প্রসারে কাজ করা। মানুষের মাঝে ক্ষুদ্র ঋণকে জনপ্রিয় করে তোলা। এ প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে একটি গবেষণা হয়েছে। তারা ১৯৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের উপর গবেষণায় দেখেছে দরিদ্র মানুষ, যারা ক্ষুদ্র ঋণ নিয়েছে- তাদের মধ্যে মাত্র ৯.৪ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠতে সমর্থ হয়েছে। সম্প্রতি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ভারতীয় বংশোদ্ভুত অভিজিৎ ব্যানার্জির একটি প্রকাশনা আছে যেখানে তিনি ৭টি দেশের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছেন। এ দেশগুলো হচ্ছে, ফিলিপাইন, মঙ্গোলিয়া, ভারত, বজনিয়া-হার্জেগোভিনা, মেক্সিকো, ইথিওপিয়া এবং মরক্কো। তার গবেষণার ফলাফল হচ্ছে এ রকম যে, ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণকারী পরিবারগুলোর আয় তেমন একটা বাড়েনি। অর্থাৎ আয় সামান্য বেড়েছে। কিন্তু পরিবারগুলো দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠতে পারেনি। পরিবারগুলোর দারিদ্র্য তেমন একটা কমেনি। তিনি আরো বলেছেন, ঋণ গ্রহণকারী পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ ঋণের টাকা তাদের হাতে আসার ফলে কিছু করার সুযোগ তাদের সৃষ্টি হয়েছে। অন্যত্র তিনি বলেছেন, দরিদ্র মানুষকে এত অল্প অর্থ দিলে তাদের তেমন কোনো উপকার হয় না। কিন্তু বেশি অর্থ দিলে তাদের উপকার হয়। ক্ষুদ্র ঋণ সংক্রান্ত এসব গবেষণার বিষয় যদি আমরা বিবেচনায় নিই তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন, তা শতভাগ সঠিক বলে মেনে নিতে হয়। ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে ঋণ গ্রহীতার কিছু আয় বাড়লেও দারিদ্র্য বিমোচন করে না। আবার যারা দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠতে পারে তারাও টেকসইভাবে সেটা ধরে রাখতে পারে না। সামান্য একটু দোলা লাগলেই তারা আবারো দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে আসে। আমি আরো একটি কথা বলতে চাই, যদিও কথাটি একান্তই আমার নিজস্ব, প্রথমে যখন ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল তখন গ্রামের মানুষের হাতে তেমন এটা অর্থ ছিল না। প্রচলিত ব্যাংকিং সূত্র থেকেও তাদের অর্থায়ন পাবার সুযোগ ছিল না। সে অবস্থায় ক্ষুদ্র ঋণ তাদের হয়তো কিছুটা সহায়তা করেছে। কিন্তু এখন প্রচলিত ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম একেবারেই প্রযোজ্য নয়। অবস্থাটা হচ্ছে, মানুষের আর্থিক অবস্থাটা বুঝে তার বাস্তবতার নিরিখে তার প্রয়োজন নির্ধারণ করে অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।

দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : আপনারা তো জামানতবিহীন ঋণ প্রদান করেন। কিছুদিন আগে মন্ত্রিপরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে এখন থেকে এসএমই খাতে জামানতবিহীন ঋণ প্রদান করা হবে। এটা দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে কতটা অবদান রাখবে বলে মনে করেন?
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ : আমি মনে করি, সরকারের এই উদ্যোগ খুবই ভালো এবং সময়োপযোগি উদ্যোগ। এর ফলে দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা লাভবান হবেন। যারা এতদিন জামানতের অভাবে ব্যাংক ঋণ পেতেন না তারা এখন সহজেই ঋণ পেতে পারবেন। তবে এই কার্যক্রম সফল করতে হলে নজরদারি প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ঋণের অর্থ অপব্যবহার হবার আশঙ্কা থাকবে। যে কাজে ঋণ দেয়া হচ্ছে সেই কাজে ঋণের টাকা ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা এটা নিশ্চিত করতে হবে। কাজটি ভালোভাবে সম্পন্ন হচ্ছে কিনা এসব জরুরি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। তাদের অগ্রগতি কেমন হচ্ছে, মুনাফা অর্জিত হচ্ছে কিনা। সরকার জামানতবিহীন এসএমই ঋণ প্রদানের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাকে আমি স্বাগত জানাই। এটা এসএমই খাতের বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। জামানতবিহীন ঋণ দেয়া হলে তার ব্যবহার এবং যে কাজে ঋণ নেয়া হচ্ছে সেই কাজটি সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। এটা করা না গেলে ঋণগ্রহীতা ঋণের কিস্তি ফেরৎ দিতে পারবে না। তাহলে ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : বিশে^র সব শেয়ার বাজারেই অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশের শেয়ারবাজারে অস্থিরতার মাত্রা একটু বেশি বলেই মনে হয়। এর কারণ কি?
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ : বিশে^র সব শেয়ারবাজারেই অস্থিরতা থাকে। তবে আমাদের দেশের শেয়ারবাজারে এ অস্থিরতার হার বা পরিমাণ একটু বেশিই বলতে হবে। এর নানা কারণ থাকতে পারে। আমি শেয়ারবাজার নিয়ে খুব একটা বেশি গবেষণা করিনি। তবে অনেক দিন ধরেই লক্ষ্য করছি দেশের শেয়ারবাজার প্রত্যাশা মতো চলছে না। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, বাজারে ভালো কোম্পানির অভাব রয়েছে। ভালো কোম্পানি শেয়ারবাজারে খুব একটা আসতে চায় না। সরকারি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ারবাজারে আসার কথা ছিল- কিন্তু তারা বাজারে আসেনি। ইতোপূর্বে অনেকবারই আমরা শুনেছি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যায়ক্রমে শেয়ারবাজারে আসবে। পূর্ববর্তী অর্থমন্ত্রীর আমলে ২৬টি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে শেয়ারবাজারে নিয়ে আসার জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারবাজারে আসেনি। শেয়ারবাজার অধিকতর ভালো এবং স্থিতিশীল করার জন্য সুপ্রতিষ্ঠিত কোম্পানি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারবাজারে নিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই। আমি মনে করি, বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ার বৃদ্ধি পেলে সাধারণ বিনিয়োগকারীর আস্থা বাড়তো। বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ নিয়ে বাজারে চলে আসতো। দুর্বল শেয়ারবাজারে থাকলে সেগুলো তো অসুবিধা সৃষ্টি করবেই, করছেও তাই। আমাদের আর্থিক আচরণে অনেক ঘাটতি রয়েছে। যারা সাধারণ বিনিয়োগকারী তাদের আচরণেও সমস্যা রয়েছে। কোনো একজন বিনিয়োগকারী যদি একদিন হঠাৎ করে প্রচুর মুনাফা লাভ করে থাকে তাহলে তার আশপাশের অন্য বিনিয়োগকারীরা সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অর্থাৎ বাজার অনেকটা হুজুকে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু শেয়ারবাজারে হুজুকে মাতলে ক্ষতির আশঙ্কা থাকবেই। আমরা যখন কোনো কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করতে যাবো তখন সেই কোম্পানির মৌলিক তথ্যাবলী সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ-খবর নিতে হবে। কোম্পানির মৌলভিত্তি কেমন, ব্যবস্থাপনা কেমন, তারা কেমন মুনাফা করছে, তারা নিয়মিত শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড দিচ্ছে কিনা এসব মৌলিক তথ্য জানা খুবই জরুরি। কোনো কিছু না জেনে বিনিয়োগ করলে সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা থাকে। তাই যারা বিনিয়োগকারী তারা যেন হুজুকে বিনিয়োগ না করে সে বিষয়ে তাদের সতর্ক এবং উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বিনিয়োগকারীকে জানতে হবে কোন শেয়ারে কখন বিনিয়োগ করতে হবে। কীভাবে কতটা বিনিয়োগ করতে হবে। শেয়ারবাজার এবং বিনিয়োগকারীদের মাঝে যারা আছেন তারা নানা ধরনের কারসাজি করেন। ফলে বিনিয়োগকারীরা প্রায়শই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করলেও তারা এক সময় বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলে নিজ দেশে নিয়ে যান। ফলে তাদের বিনিয়োজিত পুঁজি দীর্ঘমেয়াদে বাজার শক্তিশালীকরণে তেমন একটা অবদান রাখতে পারছে না।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : একজন নতুন বিনিয়োগকারী যদি মার্কেটে যায়- তাহলে তাকে লাভবান হবার জন্য কী কী বিষয় খেয়াল রাখতে হবে?
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ : একজন নতুন বিনিয়োকারী যখনই শেয়ার মার্কেটে যাবেন তার আগেই তাকে জানতে হবে শেয়ারবাজার কীভাবে কাজ করে। বাজার সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনেই বিনিয়োগ করলে তার ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা থাকবেই। এজন্য প্রশিক্ষণ থাকলে ভালো হয়। এছাড়া কোন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করবে সে সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকা দরকার। কোনোভাবেই হুজুগে বিনিয়োগ করা যাবে না। একজন কোনো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে বিপুল পরিমাণ লাভ করেছে আমিও সেখানে গিয়ে লাভবান হতে পারবো এ ধরনের মনোভার পরিহার করতে হবে। একটি কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা জেনে তারপরই সেই কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। ফান্ডামেন্টালসগুলো ঠিক আছে কিনা তা বুঝেশুনেই বিনিয়োগ করতে হবে। এসব মৌলিক তথ্য জেনে বিনিয়োগ করলে লাভবান হবার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। যদি কোনো একবার লোকসানও হয় পরবর্তীতে তা আবার পুষিয়ে নেয়া যাবে। নিকট অতীতে আমরা শেয়ারবাজারে কি প্রত্যক্ষ করেছি। কিছু বিনিয়োগকারী যখন প্রচুর পরিমাণে মুনাফা অর্জন করে তখন সব মানুষ শেয়ারবাজারে গিয়ে ভীড় করে। মতিঝিলের রাস্তা ভরে যায় বিনিয়োগকারীদের পদচারণায়। যার যতটুকু সামর্থ্য আছে তার পুরোটা শেয়ারবাজারে নিয়ে আসে। অনেকেই তাদের জমি, গহনা বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে শেয়ার ক্রয় করতে থাকে। গৃহবধূরা তাদের স্বামীকে না জানিয়ে গোপনে কোনো আপনজনের মাধ্যমে বাজারে বিনিয়োগ করে। এক সময় দেখা গেল বাজার দ্রুত পতন ঘটছে। যে দামে শেয়ার ক্রয় করা হয়েছিল বাজার মূল্য তার অনেক নিচে নেমে আসে। হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী একেবারে রাস্তায় বসে যান। অনেকের গৃহে শুরু হয় মারাত্মক দ্বন্দ্ব। অনেকের সংসার ভেঙে যায়। কেউ কেউ আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। এটা হয়েছে মূলত হুজুগে বিনিয়োগ করার কারণে। তারা যদি বিনিয়োগের আগে বাজার সম্পর্কে একটু ধারণা নিতেন তাহলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতো না। শেয়ারবাজার অনেকটা জুয়া খেলার মতো। এ বাজারে বিনিয়োগ করে কেউ একজন হয়তো প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে। আবার কেউ বা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এখানে যেমন গেইনার হবার সম্ভাবনা আছে তেমনি লুজার হবার শঙ্কাও কম নয়। তাই ভালোভাবে যাচাই-বাছাই না করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা কোনোভাবেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। শেয়ারবাজারে ধ্বস নামলে সরকারকে দায়ী করা হয়। কিন্তু না এটা সরকারের দায়িত্ব নয়। বিনিয়োগকারীদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ বিনিয়োগের সিদ্ধান্তটি সরকারের নয়, একান্তভাবেই বিনিয়োগকারীর নিজস্ব বিবেচনাপ্রসূত। শেয়ারবাজারে সবসময়ই এক শ্রেণির মানুষ থাকে যারা নানাভাবে বাজার প্রভাবিত করে ফায়দা লুটে নিতে তৎপর থাকে। সে গেমলারদের খপ্পরে পরার দায়িত্ব বিনিয়োগকারীদেরই নিতে হবে। হ্যাঁ, সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে বাজারে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবার লক্ষণ দেখা গেলেই- তা নিরসনে উদ্যোগ গ্রহণ করা।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারবাজারে আসছে না, এটা নয়। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারবাজারে আসছে না। এটা কেন হচ্ছে?
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ : বিদ্যমান অবস্থায় অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে আসবে না। কারণ তারা বুঝতে পারছে না বাজার কোন দিকে যাবে। শেয়ারবাজারে এলে লাভবান হওয়া যাবে কিনা। অর্থনীতিতে একটি সূত্র আছে, ব্যাড মানি ড্রাইভস গুড মানি আউট অব সার্কুলেশন। শেয়ারবাজারেও এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, আমার প্রতিষ্ঠান ঠিক আছে। ভালো লাভ হচ্ছে, শুধু শুধু শেয়ারবাজারে গিয়ে কোনো কাজ নেই। এ ছাড়া অনেকেই আছেন যারা নিজ প্রতিষ্ঠানের উপর পারিবারিক আধিপত্য ক্ষুণ্নের আশঙ্কায় শেয়ারবাজারে যেতে চান না।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : শেয়ারবাজারে সচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মনে করেন?
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ : শেয়ারবাজারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য ইতোপূর্বে অনেক ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। নীতি তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আসলে নতুন করে কোনো কিছু করার আছে বলে মনে হয় না। বরং ইতোপূর্বে যেসব সংস্কার সাধন করা হয়েছে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করাটাই বেশি জরুরি। শেয়ারবাজারে যাতে কোনো ধরনের ইন্টারনাল ট্রেডিং বা ইন্টারনাল ম্যানুপুলেশন না হতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। ভিতর থেকেই অনেক সময় নানা প্রক্রিয়ার মাধমে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে দেয়। আবার এক সময় দাম কমিয়ে দিয়ে একটি মহল ফায়দা লুটে নিচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : একসময় ডি-মিউচ্যুয়ালাইজেশন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, যারা শেয়ার ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত তাদের মধ্য থেকে ৪০ শতাংশ এবং অবশিষ্ট ৬০ শতাংশ সদস্য এমন হবেন যারা শেয়ার ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত নন। অভিযোগ উঠেছে, শেয়ার ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্তরা সংখ্যায় কম হলেও তারা নানাভাবে অন্যদের প্রভাবিক করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করছে। আইনটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হবার কারণ কি?
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ : আমাদের একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে আমরা নিয়মগুলো মানি না। আমার যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে আমি আমার মতো করে সবকিছু করতে চাই। আমাদের দেশে এসব ধান্ধা ধরা বা প্রতিরোধের যে ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। অন্য দেশে যে অপরাধ হয় না তা নয়। কিন্তু সেসব দেশে অপরাাধ ধরা পড়লে তার বিচার হয়। আমাদের দেশে অপরাধ করে কেউ ধরা পড়ে না। আর ধরা পড়লেও বিচার হয় না। ফলে অপরাধীরা প্রতিকারহীনভাবে অপকর্ম করে চলেছে। বিচারহীনতার কারণে অন্যেরা অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়। কাজেই শেয়ারবাজারকে সুস্থ করতে হলে যারা বিভিন্ন সময় নানাভাবে শেয়ারবাজারকে কলুষিত করেছে তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আমাদের দেশের অর্থনীতি দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। কিন্তু অর্থনীতির দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর ব্যাংক এবং শেয়ারবাজার ঠিকভাবে কাজ করছে না। ব্যাংক এবং শেয়ারবাজারকে যদি ঠিক করা না হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীরা সমস্যায় পড়বেন। তারা টাকা কোত্থেকে পাবেন?
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন : ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শেয়ারমার্কেট থেকে উদ্যোক্তারা কীভাবে প্রয়োজনীয় পুঁজির চাহিদা পূরণ করতে পারে?
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ : উন্নত দেশগুলোতে উদ্যোক্তারা তাদের পুঁজি চাহিদার একটি বড় অংশই শেয়ারবাজার থেকে সংগ্রহ করে থাকেন। আমাদের দেশে এটা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ বাজার ভালোভাবে চলছে না। আমরা যদি শেয়ারবাজারকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারতাম, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারতাম, তাহলে উদ্যোক্তারা তাদের পুঁজি চাহিদার একটি অংশ শেয়ারবাজার থেকে যোগার করতে পারতেন। শেয়ারবাজার যদি অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে তাহলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলবে। যারা তাদের কোম্পানি শেয়ারবাজারে নিয়ে আসতে চান তারাও শঙ্কিত হয়ে পড়বেন। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না। আমাদের এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। শেয়ারবাজারের জন্য নতুন করে কোনো আইন প্রণয়নের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। বরং বিদ্যমান আইনগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। আমি মনে করি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যারা শেয়ারবাজারকে পঙ্গুু করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
#

Share
নিউজটি ১১৯৩ বার পড়া হয়েছে ।
Tagged