বিশেষ সাক্ষাৎকারে ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ

সুদের হার কমানোর বিষয়টি এক পক্ষীয় নয়

সময়: রবিবার, জানুয়ারি ৫, ২০২০ ১:১৯:৪২ অপরাহ্ণ


জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন সচিব ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ মনে করেন, সুদের হার কমানোর বিষয়টি এক পক্ষীয় নয়। ব্যাংক ঋণের সুদের হার কত হবে তা নির্ভর করে ঋণের চাহিদা এবং যোগানের উপর। দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আমাদের ডেপুটি এডিটর এম এ খালেকÑ

এম এ খালেক: ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার কথা ছিল ১ জানুয়ারি ২০২০ তারিখ থেকে। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে এই সিদ্ধান্ত কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে ১ এপ্রিল থেকে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হবে। ব্যাংকিং সেক্টরের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা কি আদৌ সম্ভব হবে?

ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ: দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের দীর্ঘ দিনের একটি দাবি হচ্ছে ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হোক। কার্যত এটা একটি সার্বজনিন দাবি বলা যেতে পারে। যদি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বাবসায়-বাণিজ্যের উন্নয়ন ঘটিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করতে হয়- তাহলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। এমনিতে আমাদের দেশের ব্যাংক ঋণের সুদের হার অনেক বেশি। তাই এটা কমানোর যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে- তা যথার্থ। কিন্তু সুদের হার কমানোর বিষয়টি এক পক্ষীয় নয়। ব্যাংক ঋণের সুদের হার কত হবে তা নির্ভর করে ঋণের চাহিদা এবং যোগানের উপর। প্রশ্ন হলো যে ব্যাংক সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দেবে তাদের পুঁজির যোগান কোত্থেকে আসবে? নিশ্চয়ই তার পুঁজির যোগান আসবে আমানতকারীদের নিকট থেকে। তাহলে গ্রাহক বা আমানতকারিদের ব্যাংক কত শতাংশ সুদ প্রদান করবে? বলা হচ্ছে, ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করবে ৬ শতাংশ সুদে। আর ঋণ প্রদানকালে ৯ শতাংশ সুদ হার আরোপ করবে। তাহলে ব্যাংকের আমানত ও ঋণের সুদের হারের মধ্যে স্প্রেড দাঁড়াবে ৩ শতাংশ। এটা খুব একটা যৌক্তিক নয়। কারণ ব্যাংকগুলোর নানা ধরনের খরচ আছে। তাদের ‘কস্ট অব ফান্ড’ অনেক বেশি। কাজেই এখানে সমন্বয় সাধন করতে গিয়ে প্রথমেই একটি বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। যদি জোর করে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে ব্যাংকগুলো বিকল্প পথে তাদের লোকসান পুষিয়ে নেবার চেষ্টা করবে। তারা নানা ধরনের হিডেন চার্জ আরোপ করবে। সাধারণ মানুষের নিকট থেকে ব্যাংকগুলো ৬ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করবে। কিন্তু বাজারের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আমানতের উপর ব্যাংকের প্রদেয় সুদের হারের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা দরকার। যদি দেখা যায়, বাজারে মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশ। আর ব্যাংক আমাকে আমানতের উপর ৬ শতাংশ হারে সুদ প্রদান করছে, তাহলে কেউই ব্যাংকে টাকা আমানত রাখতে চাইবে না। কারণ এই অবস্থায় তার লোকসান হবে। জনগণের নিকট থেকে আমানত সংগ্রহের বিষয়টি বাজারের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে জড়িত। সবাই চায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানো হোক। কিন্তু বিষয়টি এক পক্ষীয় নয়। এবং জোর করে চাপিয়ে দেবার ব্যাপারও নয়। বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের উপর নির্ভর করেই এটা নির্ধারিত হতে হবে। ব্যাংক যদি ৬ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করতে না পারে তাহলে গোপনে বেশি সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করবে। আর বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করে নিশ্চয়ই তা কম সুদে বিনিয়োগ করবে না। তার কস্ট অব ফান্ড যদি ৮ বা সাড়ে ৮ শতাংশ হয় তাহলে ব্যাংক চাইলেই ৯ শতাংশ সুদ হারে ঋণ দিতে পারবে না। ফলে তাকে এখানেও নানা ধরনের ছল-চাতুরির আশ্রয় নিতে হবে। যারা ব্যাংকের মালিক তারা তুলনামূলক স্বল্প সুদের সুযোগে নিজেরাই ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে শুরু করবে। অর্থাৎ নিজের ব্যাংকের ঋণ নিজেই নিতে থাকবে। এটাও ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য অত্যন্ত জটিল একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। সুদের হার কত শতাংশ হবে তা সম্পূর্ণরূপেই বাজারের উপর নির্ভর করে। বাজারই নির্দেশ করবে সুদের হার কম হবে নাকি বেশি হবে। আরো একটি সমস্যা দেখা দেবে তাহলে যিনি ৯ শতাংশ সুদে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করলেন তিনি যদি সেই পুঁজি সঠিকভাবে বিনিয়োগ করতে না পারেন তাহলে তিনি ঋণ গ্রহণ করবেন কেনো? দেশে যদি বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকে, বিনিয়োগ করে সঠিক মাত্রায় রিটার্ন না আসে তাহলে একজন উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী কেনো ঋণ নেবে? ঋণের সুদের হার কম হলেও তিনি ঋণ গ্রহণ করতে চাইবেন না। কারণ এই অবস্থায় একজন উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী ঋণ নিয়ে বিপদে পড়বেন। কাজেই অর্থনীতির অবস্থা ভালো থাকতে হবে। অর্থনীতি গতিশীল থাকতে হবে। ৯ শতাংশ সুদে ঋণ গ্রহণ করে তিনি যদি ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ লাভ করতে না পারেন তাহলে তিনি ঋণ নিতে চাইবেন না। যিনি ঋণ গ্রহণ করবেন তার যদি ঋণের চাহিদা না থাকে তাহলে সুদের হার যতই কমানো হোক না কেনো তিনি ঋণ গ্রহণ করবেন না। কাজেই আবারো বলছি, মার্কেট শুড ডিক্টেট হোয়াট শুড বি দ্য রেট অব ইন্টারেস্ট।

এম এ খালেক: আপনার কথার সূত্র ধরেই বলছি, একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ‘কস্ট অব ফান্ড’ হচ্ছে ৮.২৫ শতাংশ। ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি। কাজেই কস্ট অব ফান্ড না কমিয়ে কোনোভাবেই কি সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা সম্ভব?

ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ: না এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে ব্যাংকের পদচারণা, পরিচালনা কেমন হবে। কিভাবে তার কার্যক্রম পরিচালিত হবে সেটা নির্ভর করে তারল্য পরিস্থিতির উপর। যদি দেখা যায়, কোনো ব্যাংকের প্রচুর ঋণের টাকা আটকে আছে গ্রাহকের নিকট। তাহলে সেই ব্যাংক চাইলেও কম সুদে ঋণ নিতে পারবে না। কারণ খেলাপি ঋণের জন্য ওই ব্যাংককে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। আরো নানা ব্যয় আছে। ঋণের কিস্তি কারো নিকট আটকে গেলে ব্যাংক নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তার ঋণ প্রবাহ স্থবির হয়ে পড়ে। ব্যাংক লাভসহ ঋণের কিস্তি আদায় করতে না পারলেও আমানতকারীদের ঠিকই সুদ প্রদান করতে হয়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে অর্থনীতি সচল এবং গতিশীল না হলে, যথাযথভাবে ইম্প্যাক্ট ওরিয়েন্টেড কাজ না নিতে পারলে সেই অর্থনীতিতে শুধু ব্যাংক ঋণের সুদের হার বড় নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারবে না।

এম এ খালেক: সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে একমাত্র রেমিটেন্স আহরণ খাত ছাড়া অর্থনীতির অধিকাংশ সূচকই নিম্নমুখী প্রবণতায় রয়েছে। বিশ^ অর্থনীতিতে যে মন্দাবস্থা বিরাজ করছে তা আমাদের দেশের মতো অর্থনীতিকে দীর্ঘ মেয়াদে আরো ক্ষতিগ্রস্থ করবে কি?

ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ: চীন-মার্কিন বাণিজ্য বিরোধের কারণে বিশ^ব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে তা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিকে দীর্ঘ মেয়াদে আরো ক্ষতিগ্রস্থ করবে। বিশ^ব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার অর্থই হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা হ্রাস পাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমার পণ্যের রফতানি চাহিদা কমে যাবার অর্থই হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমি উচ্চ ব্যয়ে পণ্য ও সেবা উৎপাদন করলাম কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে সেই পণ্যের সঠিক দাম পাওয়া গেলো না। তাহলে স্থানীয় উৎপাদক শ্রেণী ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কাজেই আন্তর্জাতিক বাজারের যে কোনো পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে আমাদের অর্থনীতির উপর প্রভাব বিস্তার করবেই। কাজেই আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অভিঘাতগুলোও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। আবারো বলছি সুদের হার কম বেশি সেটা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ তার চেযে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি কতটা সচল আছে। অর্থনীতি কতটা গতিশীল আছে। এই গতিশীলতা শুধু আমাদের দেশের অর্থনীতি চলনশীল বা গতিশীল থাকলে হবে না। বিশ^ অর্থনীতিই চলনশীল থাকতে হবে। তা না হলে আমদানি-রফতানি সব স্থানেই বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিশে^র প্রতিটি দেশই এখন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। কাজেই একটিকে বাদ দিয়ে আর একটি দেশের উন্নয়ন আশা করা যায় না।

এম এ খালেক: আপনি একবার বলেছিলেন, দুর্নীতি বন্ধ অথবা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ ব্যবহারের সুযোগ না দেয়া হলে মুদ্রা পাচার বন্ধ করা যাবে না। কেউ কেউ বলতে পাচ্ছেন, মুদ্রা পাচার বন্ধ হলেই দুর্নীতি বন্ধ হবে। এটা কতটা সত্যি?

ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ: আমি মনে করি, দুর্নীতি বন্ধ হলে অথবা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ প্রশ্নাতীতভাবে অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হলে মুদ্রা পাচার অনেকটাই কমে যাবে। প্রতিটি দেশের অর্থনীতি একটি প্রবণতা দিয়ে চলে। প্রশ্ন হলো, একজন মানুষ তার উপার্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করে কেনো? কেউ যখন দেখতে পায় উপার্জিত অর্থ তিনি ব্যবহার করতে পারছেন না অথবা অভ্যন্তরীণভাবে টাকার নিরাপত্তা বিধান করতে পারছেন না তখন তিনি মুদ্রা পাচারের মতো কাজ করবেন। কারণ অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ ধারন করলে তাকে বিপদে পড়তে হতে পারে। তাই তিনি নিজের এবং উপার্জিত অর্থের নিরাপত্তা বিধানের জন্য মুদ্রা পাচার করতে পারেন। কেউ তো আর টাকা অলস ধরে রাখবে না। তাহলে টাকার মূল্যমান কমে যাবে। এছাড়া নিরাপত্তার বিষয়টিও রয়েছে। কাজেই উপার্জিত অর্থ যদি যথাযথভাবে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ব্যবহারের ব্যবস্থা না থাকে তাহলে তা পাচার হতেই পারে। কেউ যদি বলেন, পাচার না হলেই দুর্নীতি কমে যাবে এই কথাটি মোটেও ঠিক নয়। কারণ কেউ পাচার করার উদ্দেশ্যে দুর্নীতি করে না। বরং দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ স্থানীয়ভাবে অবাধে ব্যবহারের সুযোগ থাকে না বলেই বাইরে পাচার করে। দুর্নীতির একমাত্র উদ্দেশ্য বা কারণ দুর্নীতি নয়। বরং দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত টাকা অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবহারের সুযোগ থাকে না বলেই মানুষ টাকা পাচার করে।

এম এ খালেক: আপনি তো চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে শেয়ারবাজারে যে স্থবিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে এর কারণ কি?

ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ: শেয়ারবাজারের অবস্থা হচ্ছে এমন যে সামনে খাবার আছে কিন্তু সেই খাবার কেনার মতো সামর্থ আমার নেই। আবার খাবার কেনার সামর্থ আছে কিন্তু সামনে ভালো খাবার নেই। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানির অভাব রয়েছে। অনেকেই আছেন যারা বিনিয়োগ করতে চান বিনিয়োগ করার মতো সামর্থ আছে। কিন্তু বাজারে ভালো শেয়ার নেই। বাজারে ভালো শেয়ার না থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো শেয়ারবাজারে আসেনি। অথচ সব বিনিয়োগ তারাই করছে। লাভ-লোকসান তাদেরই হচ্ছে। পদ্মা সেতু বা এ ধরনের মেগা প্রকল্পের সবগুলোই তো রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান পুঁজি বাজারে আসছে না। এসব বড় বড় প্রকল্প পুঁজি বাজারে এলে এক ধরনের চাহিদা সৃষ্টি হতো। মানুষ মনে করতো পদ্মা সেতুতে আমার একটি শেয়ার কেনা থাকুক। কিন্তু সেই সুযোগ তাদের দেয়া হচ্ছে না। অর্থাৎ সরকার বড় বিনিয়োগকারী হয়েও পুঁজি বাজার থেকে টাকা উত্তোলন করছে না। মূলত সে কারণেই পুঁজি বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ার নেই। বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি আমাদের দেশে ব্যবসায় করছে। তারা প্রচুর অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা পুঁজি বাজারে আসছে না। শুধু গ্রামীণ এবং এ ধরনের আরো দু’একটি কোম্পানি বাজারে এসেছে। কিন্তু অন্য কোম্পানিগুলো বাজারে আসছে না। পিডিবি, বিটিসিএলের মতো দেশের বড় বড় কোম্পানি কিন্তু তারা পুঁজি বাজারে আসছে না। আমি অর্থমন্ত্রণালয়ে থাকাকালীন সময়ে একটি কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা বাজারে আসেনি। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বাজারে যাচ্ছে না। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও বাজারে আসছে না। এমনকি ব্যক্তি খাতের বড় বড় কোম্পানিগুলোও শেয়ারবাজারে আসছে না। ফলে বাজারে ভালো শেয়ারের অভাব রয়েই যাচ্ছে। তাই ইচ্ছে থাকা সত্বেও অনেকেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। বড় বড় কোম্পানি মনে করে, শেয়ারবাজারে গিয়ে পঁচা ডিম খাওয়ার দরকার কি। আমার তো পুঁজির দরকার নেই। অথবা তারা মনে করছেন, যেহেতু পুঁজিবাজার ভালোভাবে চলছে না তাই সেখানে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে সর্বস্ব হারানোর ঝুঁকি নেয়া। প্রতিটি স্তরেই সময় ক্ষেপন করা হয়। প্রতিটি স্তরেই অর্থ ব্যয় করতে হয়। কাজেই জুতোর তলা খালি করে আমার পুঁজি বাজারে যাওয়ার দরকার কি? পুজিবাজারে যাচ্ছে ‘হায় হায়’ কোম্পানিগুলো যাদের পুঁজির প্রচন্ড দরকার। যাদের ব্যাংকে ঋণ আছে। তারা সেই ঋণের টাকা শোধ করার জন্য পুঁজি বাজারে যাচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অসুস্থ্য লোকেরাই পুঁজি বাজারে যাচ্ছে। সুস্থ্য লোকেরা পুঁজি বাজারে যাচ্ছে না। অর্থাৎ ভালো কোম্পানির শেয়ার বাজারে আসছে না। এটাই হচ্ছে সাপ্লাই সাইডের সমস্যা। বিনিয়োগকারীরা তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথমত হচ্ছে সেকেন্ডারি মার্কেটে যারা বিনিয়োগ করেন সেই সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তারা তাদের সহায় সম্বল নিয়ে এসে এখানে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু আমাদের শেয়ারবাজারে ট্রেডিং-এর যে এত উত্থান-পতন সেখানে বসে বসে পুঁজি খোঁয়াতে হয়। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, গ্রামীণ এবং এ্যাক্টিভ ফাইন এসব কোম্পানিতে আমার কিছু বিনিয়োগ আছে। আমার টাকার পুরোটাই গেছে। আমি পুঁজি হারিয়ে বসে আছি। আমি তো ধৈর্য ধারন করে আছি। এখন আর বাজারের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করি না। আমি হয়তো ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছি। কিন্তু যিনি স্বল্প আয়ের মানুষ তিনি তো এই অবস্থা সহ্য করতে পারবেন না। মানুষ তার কষ্টার্জিত টাকা হারিয়ে বিনিয়োগ করতে চাইবে না। পুঁজিবাজারে দ্বিতীয় এবং মূল বিনিয়োগকারী হচ্ছে ব্যাংক তা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তাদের অবস্থাই এখন ত্রাহি মধুসূদন। তারা পুঁজি বাজারে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। কারণ পুঁজিবাজারে গিয়ে পুঁজি হারালে কে তার জবাব দেবে? মূলত এসব কারণেই তারা বাজারে আসছে না। তৃতীয়ত, যারা বিদেশি বিনিয়োগকারী তারাও বাজারে আসছে না। এমন কি তাদের পূর্বের বিনিয়োজিত পুঁজি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। পুঁজিবাজার হচ্ছে শ্রেষ্ঠ রক্তক্ষরণের স্থান। এই রক্তক্ষরণ না থামলে কিছু হবে না।

এম এ খালেক: বিনিয়োগকারী, যিনি প্রথম পুঁজিবাজারে যাবেন তিনি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কি কি দিক লক্ষ্য রাখবেন?

ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ: একজন নতুন বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার আগে ভালোভাবে দেখে-শুনে বিনিয়োগ করবেন। কোনোভাবেই হুজুগে বিনিয়োগ করা যাবে না। বিনিয়োগ করার আগে তাকে দেখতে হবে যে কোম্পানির শেয়ারে তিনি বিনিয়োগ করতে যাচ্ছেন সেই কোম্পানির মৌলভিত্তি কেমন? প্রতিষ্ঠানটি ঋণ গ্রস্থ কিনা, তার পরিচালনা ব্যবস্থা কেমন। কোম্পানিটি প্রতি বছর কি পরিমাণ লভ্যাংশ প্রদান করে- এসব মৌলিক তথ্য ভালোভাবে জেনেই একটি কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে। ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করলে ক্ষতিগ্রস্থ হবার আশঙ্কা কম থাকে। আমাদের দেশের কিছু সংখ্যক কোম্পানি ছাড়া বাকিরা বাজারের খবরই রাখে না। হয়তো ব্যাংকে ৩০ কোটি টাকা ঋণ আছে, পুঁজিবাজার থেকে সেই অর্থ উত্তোলন করে তা দিয়ে ব্যাংক ঋণ শোধ করে দিচ্ছে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী এই টাকা তো কোম্পানির উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করা উচিৎ ছিল। কোম্পানির সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া যেতো। এতে কোম্পানির লাভ হতো। সেই লাভের একটি অংশ বিনিয়োগকারীদের প্রদান করার কথা কিন্তু তা না করে অনুৎপাদনশীল খাতে তা ব্যবহার করা হলো। ফলে পরবর্তী বছর কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের মুনাফা দিতে পারে না। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমার নিকট ৫ হাজার টাকা আছে। আমি এই টাকা দিয়ে একা কিছু করতে পারছি না। আপনার কিছু করার ক্ষমতা আছে আপনাকে এই টাকা দিলাম। আপনি কিছু করেন। আপনি লাভবান হোন আর আমাকেও কিছু লাভ দিন।

এম এ খালেক: কিছু দিন আগে অনেকটা হঠাৎ করেই দেখা গেলো দুর্বল মৌলভিত্তি সম্বলিত লোকসানী কোম্পানি যারা হয়তো ঋণ গ্রস্থও বটে তাদের শেয়ার দর অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলো। এর কারণ কি?

ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ: এখানে এক ধরনের কারসাজি কারছে বশে আমি মনে করি। আমাদের শেয়ারবাজারে একটি মহল আছে যারা নানাভাবে কারসাজি করে শেয়ারের দাম বৃদ্ধি বা হ্রাস করিয়ে থাকে। মহল বিশেষ ইচ্ছে করলেই একটি কোম্পানির শেয়ারে মূল্য কমিয়ে দিতে পারে। আবার উল্টোটিও হতে পারে।

এম এ খালেক: আপনি কিছু দিন আগে একটি পত্রিকায় দলীয় বিবেচনায় শীর্ষ পদে নিয়োগদানের ফলে যে অসুবিধা সৃষ্টি হচ্ছে তা নিয়ে নিবন্ধ লিখেছেন। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য দলীয় বিবেচনায় নিয়োগদান কতটা ক্ষতিকর বলে মনে করেন?

ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ: ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান শুধু নয়, যে কোনো প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতার পরিবর্তে শুধু দলীয় পরিচয়ে কাউকে নিয়োগদান প্রচন্ড রকম ক্ষতিকর। বলা ভালো যে, এটা যে শুধু বর্তমান সরকার আমলেই হচ্ছে তা নয়। অতীতেও আমরা একই প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। যাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। এখন কাউকে যদি শুধু দলীয় বা গোষ্ঠীগত বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়। তাকে ১০ লাখ টাকা বেতন দেয়া হয়। এমন একজন ব্যক্তি তো সব সময মনে করবেন যেহেতু এই পদে থাকার কোনো যোগ্যতা তার নেই। তাই যে কোনো সময় চাকরি চলে যেতে পারে। এ অবস্থায় তিনি নিয়োগ কর্তার যে কোনো কথা শুনতে বাধ্য।

Share
নিউজটি ৯৭৩ বার পড়া হয়েছে ।
Tagged