১৯৯৬’র শেয়ার কেলেঙ্কারির মামলায় ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েসের হাজিরা আজ

সময়: মঙ্গলবার, অক্টোবর ১৫, ২০১৯ ৯:২৪:৪৫ পূর্বাহ্ণ


নুরুজ্জামান তানিম : প্রসপেক্টাসে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েস’-এর বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন’ (বিএসইসি)-এর দায়ের করা শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলার হাজিরার দিন আজ মঙ্গলবার। এ দিন সকালে পুঁজিবাজার বিষয়ক বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আসামিপক্ষ হিসেবে ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েসের সংশ্লিষ্ট আইনজীবী মামলাটির বিষয়ে হাজিরা দেবেন।

বর্তমানে মামলাটি ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েসের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের নির্দেশে ছয় মাসের জন্য স্থগিত রয়েছে। এ স্থগিতাদের মেয়াদ শিগগিরই শেষ হচ্ছে। ফলে হাজিরার এ দিনে আসামিপক্ষ মামালাটির সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে বিশেষ ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করবে। পাশাপাশি হাইকোর্টের নির্দেশ ওই স্থগিতাদেশের কপিও আদালতে দাখিলের কথা রয়েছে।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিষয়ক বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেট মো. জালাল শেখ ‘দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন’-কে বলেন, ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েসের বিরুদ্ধে বিএসইসি’র দায়ের করা মামলার হাজিরার দিন মঙ্গলবার। এদিন সকালে আসামিপক্ষ মামলাটির সর্বশেষ অবস্থা জানাতে আদালতে হাজিরা দেবেন।’

এদিকে মঙ্গলবার শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলাটির হাজিরার বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষ ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের (বিএসইসি) আইনজীবী ও গ্রীনভিউ ‘ল’ কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাসুদ রানা খান ‘দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন’-কে বলেন, ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েসের মামলাটি হাইকোর্টের নির্দেশে ছয় মাসের জন্য স্থগিত রয়েছে। হাইকোর্টের ওই স্থগিতাদেশের কপি পুঁজিবাজার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দাখিলের জন্য আসামিপক্ষকে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে।’

আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালের ১৭ জানুয়ারি ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েসসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে বিএসইসি। পরে মামলাটি দায়রা জজ আদালত থেকে গত ১২ জুন ২০১৫ তারিখে পুঁজিবাজার বিশেষ টাইব্যুনালে স্থানান্তর হয়। বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মামলার নম্বর দেয়া হয় ১৫/১৫। পরে ওই মাসেই মামলাটি চার্জ গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট মামলাটির কার্যক্রমের উপর স্থগিতাদেশ দেন। এরপর থেকেই মামলাটি হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। এ মামলার মোট ১১ জন আসামি রয়েছেন। এর মধ্যে মাত্র একজন আসামি (প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও এমডি কামরুন্নেচ্ছা) জামিনে আছেন। বাকিরা পলাতক রয়েছেন।

আসামিরা হলেনÑ ওয়ান্ডার ল্যান্ড টয়েস লিমিটেড, প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও এমডি মিসেস কামরুনেচ্ছা, মো. মুকতাদুল হক হায়দারী, এএ ভাসওনী, মনোনীত পরিচালক, ফাঙ্কায় চেন, ন্যাশনাল সিকিউরিটিজ অ্যান্ড কনসাল্টেড লিমিটেড, পরিচালক খান মোহাম্মদ একরামুল্ল্যা, শাহজাহান কবির, সৈয়দ শফিকুল হক, হাবিবুল ইসলাম হক ও মোস্তফা বিল্লাহ খান।
মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েস অসৎ উদ্দেশে, ইচ্ছাকৃত ভাবে প্রসপেক্টাসে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রতারিত করেছে। মূলত কোম্পানিটি তাদের শেয়ার বিক্রি জোরদার করার লক্ষ্যে এ পন্থা বেছে নিয়েছে, যা বিএসইসি’র তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।

নথিতে বিএসইসি’র তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েস লিমিটেড কোম্পানি আইন, ১৯৯৩ এর অধীন নিবন্ধিত জয়েন্ট ভেঞ্চারে পরিচালিত একটি কোম্পানি, যা ১৯৯৬ সালের আগস্টে ৫ কোটি টাকার পুঁজি সংগ্রহের জন্য প্রতিটি শেয়ার ১০০ টাকা করে মোট ৫ লাখ সাধারণ শেয়ার ইস্যুর জন্য প্রসপেক্টাস প্রকাশ করে। ওই প্রসপেক্টাসে উল্লিখিত কোম্পানির প্রোজেক্ট ডিজাইনে ১০০ ভাগ রফতারিমুখী প্লাস্টিক বডি ইলেক্ট্রনিক্স (যান্ত্রিক ও ব্যাটারি চালিত) খেলনা ও মাইক্রোমটর (ম্যানুফ্যাকচারিং কাম এসেমব্লিং) এর কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। ওই তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা প্রসপেক্টাস বিএসইসিকে প্রদর্শন করে পুঁজি সংগ্রহের জন্য সম্মতি গ্রহণ করে।

এদিকে ১৯৯৫ সালের ১৬ জুন ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েস মেশিনারিজ আমদানি করা লক্ষ্যে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এর প্রধান শাখার মাধ্যমে মেসার্স এসির‌্যাঙ্ক ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের অনুকূলে মোট ১৬ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলারের একটি এলসি খোলে। ওই এলসি’র বিপরীতে পাঁচটি শিপমেন্ট হয়েছে বলে জানায়। এর মধ্যে সর্বশেষ শিপমেন্টটি ৩ লাখ ৮২ হাজার ৮৬০ মার্কিন ডলারের করা হয়েছে, যা সিঙ্গাপুরের মেসার্স সিটার লাইনস প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে বিল অফ লেডিং ইস্যু করা হয়েছে। বিল অফ লেডিং অনুযায়ী ওই শিপমেন্টের মেশিনারিজগুলো ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েসের অনুকূলে বাংলার মনি ভয়েজ ৫৮ ডব্লিউ ভ্যাসেলের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে বলে দেখানো হয়। পরে সর্বশেষ ওই মেশিনারিজের চালান ছাড়ের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে ১৯৯৬ সালের ১০ জানুয়ারি ওশেন বিল অব লেডিং (লেডিং নম্বর- জিকে/এসএল/সিটিজি ১০১) এবং ১১ জানুয়ারি ইনভয়েজ (ইনভয়েজ নম্বর- এ ১০৬) সংগ্রহ করে ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েস।
এরপর ১৯৯৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েস বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংককে অরিজিনাল শিপিং ডকুমেন্ট হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ জানায়। পরে ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক একটি সার্টিফিকেট ইস্যু করে জানায় যে, ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েসের আমদানিকৃত মেশিনারিজগুলো ১০০ ভাগ রাফতানিমুখী খেলনা প্রস্তুত শিল্পে ব্যবহার হবে।

একইভাবে ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েস বিনিয়োগ বোর্ড থেকেও ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি সার্টিফিকেট (বি:বো:/নি:স:-১/২৫৩/৯০/২১৯) সংগ্রহ করে।

তবে এর আগেই ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েসের উল্লিখিত শিপমেন্টের জাহাজ (বাংলার মনি ভয়েজ ৫৮ ডব্লিউ) ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। তবে জাহাজ পৌঁছলেও ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েসের সেই শিপমেন্ট আসেনি। ফলে এ বিষয়টি জানিয়ে ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েসকে জানিয়ে চিঠি দেয় বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন। চিঠিতে জানায়, ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলার মনি ভয়েজ ৫৮ ডব্লিউ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে। তবে উল্লিখিত মালামাল ওই জাহাজে লোড করা হয়নি।

পরে প্রসপেক্টাস প্রকাশের পর ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েস দাবি করে যে, সাপ্লায়ার উল্লিখিত মেশিনারিজের শিপমেন্ট করে নাই। পরে শিপমেন্ট না আসার বিষয়টি জানা সত্ত্বেও কোম্পানিটি ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে ৫ কোটি টাকার পুঁজি সংগ্রহের জন্য প্রতিটি শেয়ার ১০০ টাকা করে মোট ৫ লাখ শেয়ার পাবলিক অফারের মাধ্যমে বিক্রির জন্য প্রসপেক্টাস ইস্যু করে।

এ বিষয়টি বিএসইসি’র তদন্তে সুস্পষ্টভাবে উঠে আসে। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শিপমেন্ট না আসার তথ্য ওয়ান্ডারল্যান্ড টয়েস জানা সত্ত্বেও প্রসপেক্টাসে উল্লেখ করেনি। অসৎ উদ্দেশে, ইচ্ছাকৃতভাবে এ বিষয়টি গোপন রেখেছে কোম্পানিটি। বরং কোম্পানিটি সে সময় প্রসপেক্টাসে উল্লেখ করে যে, ‘উক্ত কোম্পানির হংকং কাউন্টার পার্টি তাদের জয়েন্ট ভেঞ্চার এগ্রিমেন্টের অধীন ইতোমধ্যে প্ল্যান্টের সকল মেশিনারিজ সরবরাহ করেছে এবং আমদানিকৃত সকল যন্ত্রপাতি ইন্সটলেশন হয়েছে।’ প্রকৃতপক্ষে কোম্পানিটির সকল তথ্য ‘মিথ্যা ও তঞ্চকতাপূর্ণ’। অন্যভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশে প্রতারণার মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করে শেয়ার বিক্রি জোরদার করার জন্য এবং শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে প্রসপেক্টাসে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে কোম্পানিটি ১৯৯৬-৯৭ থেকে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে মুনাফা করতে না পারায়, বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ প্রদান করেনি। এতে প্রতারিত হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
ফলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ১৯৬৯ এর ১৭ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে নথিতে উল্লেখ করা হয়।
দৈনিক শেয়ারবাজার প্রতিদিন/এসএ/খান

Share
নিউজটি ৬০৬ বার পড়া হয়েছে ।
Tagged